আজগর একটু কোনার দিকে। বারিকের সোজাসুজি ছিল জরিনা। তখন জরিনা উঠে আজগরের কাছে আসে। বলে, ক্যান?
আজগর জানায়, কী? মনে করছো বুড়ায় ঘুমায়? উঁহু, সব দেহে। কতবার আমরা পরীক্ষা কইরগা দেকচি, সব দেহে–ওইরম চক্ষু বোঝা থাকলে হইচে কী?
তাই নাকি? জরিনা অবাক। হাত সাফাইয়ের অভ্যাস আছে তার। কাজটা একেবারে খারাপ পারে না সে, আজগর জানে। কয়েকদিন আগে জরিনার কাপড় কাঁচার সাবান আজগর গায়ে ঘষে নাইতে লাগলে, সে বলেছিল আইনে দেবানে। সত্যি পরদিন বিকালে জরিনা একখানা কসকো সাবান নিয়ে হাজির। আজগর জানতে চেয়েছিল, পাইলা কী কইরে? জরিনার সোজা উত্তর, বাজারে এক দোকানে কী ভিড়। সাবান দেকতি দেকতি একখান টেকে গুইজে নিয়ে চইলে আসলাম। আজগর হেসেছে, এইসব করো! ধরা খাইল এহেবারে চুইদে দেবে। মাইনষের তা না কইয়া আনো, দাম না দিয়ে! এতেও জরিনার উত্তর, হুঁ, ওইসব মাহাজোনগো কত আছে। অত বড়ো বড়ো দোকান, ওই জায়গায় দে আমার মতন মানুষ একখান সাবান নিলি কী হয়?
ফলে, জরিনার এখনকার তাই নাকির উত্তর একটু গলা নামিয়ে আজগর বলল, তা ছাড়া কী? এইহানে কী সব বই আছে, সেতে চোদাচুদি লেহা থাহে, সেগুলোর একখানে হাত দিলিই বুড়ো চোখ খুলে তাকায়।
জরিনা আজগরের কথায় একটু যেন লজ্জা পায়। কিন্তু তার জানা আছে এমন কথা সে আগেও শুনেছে। এমনকি বই সাজানোর সময় বাঁধা বইগুলোর ভিতরে পুরুষ মহিলার ছবি দেয়া অমন বই দুই-একখানা দেখেওছে সে। কিন্তু ওই বইয়ের ভিতরে কীভাবে ওই কথা লেখা থাকে, ছাপা অক্ষরে ওইসব কথা কীভাবে লেখে শিক্ষিত মানুষ, কোনওভাবেই জরিনা ভেবে পায় না।
এই সময়ে, ওই ঈষৎ হাসিমুখের জরিনার কাছে কথাটা জানতে চেয়েছিল আজগর। তাছাড়া কথা ঘুরানোরও সময়। আশেপাশে কেউ তাদের কথা শুনে ফেললে কী ভাববে? জরিনার যা মুখ, দেখা গেল বারিক বুড়োকে জিজ্ঞাসাই করে বসল, কোন বইতে ওইসব লেখা আছে। তার একখানা তার চাই, তারপর খুঁজে বের করবে কে তাকে সেই বই পড়ে শোনাতে পারে। এই ভেবে আজগর বলল, ওই জরি, তুমি ওই ছেমড়িরে চেনো কী বিলে?
জরিনা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জানতে চাইল, কোন ছেমড়িরে?”
বারিকের দোকানের বইয়ের সামনে থেকে জরিনাকে সরানোর জন্যে আজগর এবার উলটো দিকে ইব্রাহিমের মজমার দিকে চেয়ে থাকল। জানে, জরিনা এবার তার সঙ্গে কথা বলার জন্যে এদিকেই তাকাবে। আজগর বলল, ওই যে সুকুমারের সাথে গেল।
ও, ওই ঝিলিকরে? আর কইয়ে না, ওরে না চেনে কেডা? আমার সাথে কয়দিন আগে রেল স্টেশনে দেহা হইল। কোনও বিষয় নিজের মতো করে বুঝিয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকলে জরিনা তখন দ্রুত কথা বলে। কোন দিক থেকে কী বলে তার প্রায় ঠিক থাকে না।
কবে দেহা হইল? কতদিন আগে? আজগর বুঝতে চায় আসলে জরিনার সঙ্গে কখনও ওই মেয়েটির আগে দেখা হয়েছে, নাকি আদৌ দেখা হয়নি, নাকি তারা পূর্ব পরিচিত। কিন্তু আজগরের মনে হল, একথা এখন আর জিজ্ঞাসা না-করাই ভালো। ইব্রাহিমের শেষ। এখন মানুষজনের ভিড় ফেটে যাওয়ার আগেই তাকে চত্বরে ঢুকতে হবে। একটা বানর তার হাতে ধরা। অন্যটা দড়ি খুব খাটো করে বারিকের পাশের গাছটার পাশে একটা কংক্রিটের খণ্ডের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। একসঙ্গে থাকলে মারামারি করে, কখনও হুটোপুটি করে, তাতে শক্তি ক্ষয় হয়, বানরের খিদে লাগে। সেই সকালে দুটো কলা খেতে দিয়েছিল, তারপর আর কিছুই খেতে দিতে পারেনি। আজগর জানে, বানর দুটোর খিদে লেগেছে। কিন্তু এখন কিছুই দেয়ার মতো তার হাতে নেই। এমনকি একটু আগে একটা বিড়ি সে চেয়ে খেয়েছে মোসলেমের কাছ থেকে। আজগর জরিনাকে ঝিলিকের বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না। এখনই তার ইব্রাহিমের ওই জায়গায় গিয়ে বানরের মজমা মিলানো দরকার। জরিনা বারিকের দোকানের এক কোনায় বসে। আজগর সামনে এগিয়ে যায়। জরিনা এখন বসে বসে দেখবে আজগর কীভাবে বান্দরনাচানো আসর জমায়।
এই বানর দুটোকে নিয়ে একটু আগে ইব্রাহিমের বসা জায়গায় বসল আজগর। দুটো বানরই তার কাছে, বাম হাতের দড়িতে গোটানো। ডান হাতে ডুগডুগি। ছন্দ মিলিয়ে ডুগডুগি বাজায় সে। আর মুখে বলে, এই ল্যাঙেড়া পাহাড়ের বুড়া তুড়া! আসেন আসেন, আইচে ল্যাঙেড়া পাহাড় থেকে এক বানর বুড়াবুড়ি। আপনাগো খেলা দেখাবে।
আশ্চর্য এতক্ষণ ইব্রাহিম শেখের মজমায় বাচ্চারা, এক্ষেত্রে বালক-কিশোর, প্রায় কেউ ছিলই। শহরের স্কুল সব খোলা। চাইলেই ওই বয়েসের বালকরা এখানে থাকতে পারে না। কিন্তু আজগর ওখানে যাওয়ার পরে, বার দুই ডুগডুগি বাজিয়ে তার সঙ্গী এই বানর দুটোর গুণকীর্তন করতে করতে ওই বয়েসি কয়েকজন এসে হাজির হয়েছে। এখন হয়তো স্কুলে টিফিনের সময়। অথবা তারা স্কুল পালিয়েছে। এমনিতে বোঝা যেত না। কিন্তু কারও পরনে সাদা শার্ট নেভি-ব্লু প্যান্ট, কারও পরনে উপরে সাদা নীচেও সাদা, কারও পরনে উপরে কমলা নীচে কোনও ঠিক নেই। অর্থাৎ এরা সরকারি স্কুল, টাউন স্কুল আর আমলাপাড়া স্কুলের ছাত্র। আজগর তাদের দেখেই বুঝতে পারে। এ বাদে স্কুলের পোশাক না-পরাও দুই-চারজন আছে। এরা কেউই তার বানর খেলা দেখে টাকা-পয়সা দেবে না। কিন্তু হাততালি দেবে। আজগর খেলা দেখাবে, সেই খেলা দেখাতে তালিরও তো দরকার আছে। ফাও তালি দেয়ার লোক সে পাচ্ছে কোথায়?