নাগেরবাজারের দিকে নদীর পাড় ধরে কিছুটা এগোলে হাফেজের রুটির দোকান। কিছুক্ষণ আগে সেখানেই বসেছিল সুকুমার আর ঝিলিক। জরিনাও গিয়েছিল রুটি কিনতে। এই দোকানের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। তবে আটাটা টেকা আর রুটি বানাতে গরম পানি ব্যবহার করে। রুটিগুলো নরম। রুটির সঙ্গে আখের পাটালি আর দয়াকলা (বিচিকলা) দেয়। গুড়ের দাম প্রায় সময়ই একই, তবে কলার দাম কেনার দাম বদলায়। এখানকার ক্রেতা বা একইসঙ্গে পাশের বেঞ্চিতে বসে খাওয়ার ভোক্তা প্রায় সবাই শ্রমজীবী। কেউ নদীর পাড়ের স-মিলে কাঠ চেরাই করে, কেউ কুড়ালে কাঠ ফাড়ে, কেউ রিকশা চালায়, কেউ লঞ্চঘাটের কুলি অথবা কেউ এই আজগর জরিনা আর সুকুমার ঝিলিকের মতো। আরও আছে, এখানে জরিনা বা ঝিলিক প্রায় পরজীবী। কিন্তু কোর্টচত্বরে সারাদিন ছালা গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকা পাগল আছে, কখনও কখনও দিনে জাগে আর সারাটা রাত্তির কোর্ট চত্বর পাহারা দেয়া। সেই রহম বা রহমত পাগলও আসে এখানে।
যদিও এমন রুটির হোটেল আরও কয়েকটি আছে। তবে সেগুলোর বেশির ভাগই সন্ধ্যা রাতে বন্ধ হয়ে যায়। এটাই এই লঞ্চঘাট আর কোর্ট চত্বর এলাকায় খোলা থাকে। মেইন রোডে ভাতের হোটেল আছে অনেকগুলো। আবাসিক হোটেলের পাশের গলিতে উঁকি মারলেও ভাতের হোটেলের রান্নার গন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু সেগুলোয় একবেলার ভাত খাওয়ার মতন পয়সা সব সময় তাদের কারও পকেটে থাকে না। তাছাড়া অনেকেই সকালে কোর্ট চত্বরে যাওয়ার আগে পেট ভরে ভাত খায়। সেই ভাতেই চলে সারাটা দিন। সন্ধ্যার মুখে একটু চা-মুড়ি যদি জোটে, তাও চাবায়।
সন্ধ্যার পর পর কোর্ট চত্বর ও এর আশপাশ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। বড়ো লাল দালানটায় তখন বাতি জ্বলে। সেই আলো এমন যে ওই ডিস্ট্রিক জজ বসার বিল্ডিঙেয়র বারান্দায়ও সেই আলোর আভা ভালোমতো যেন ঘুমাতে পারে না। লালচে মিটমিটে একটা বর্ণ ধারণ করে। ওদিক রাস্তায় আলো পড়ে না, সব গাছের পাতায় আটকে যায়। ডিসির বাড়ির গেটের দুই দিকের খাম্বায় আলো, সেখান থেকে ক্লাবের দিকে যেতে ডান পাশে ট্রাফিক ব্যারাকের বারান্দা অন্ধকার, শুকলাল সংগীত বিদ্যাপীঠ সন্ধ্যার পরে কেউ নেই। পাশে ক্লাবে উঠে যাওয়ার সিঁড়িতে আলো। সামনের জেলখানা পুকুরের পাশ দিয়ে ক্লাব চত্বরের ভিতরে টেনিস লনে আলো। সেই আলোতে পুকুরের জল চকচক করে। এক দিকে ফ্লাড লাইটের আলো গিয়ে লাগে পুকুরের ওপারের জেলখানা উঁচু দেয়ালের গায়ে। বামের হাতায় রেডক্রস ব্লিডিং ও সামনের স্বাধীনতা উদ্যানের ভিতরের যুবকেন্দ্রে রাত একটু বাড়লেও তরুণেরা খেলতে থাকে।
এই এলাকায় বাসাবাড়ি নেই। সন্ধ্যার পরে বাজারঘাটের সঙ্গেও কোনওপ্রকার সংযোগ নেই। মানুষজনই তো নেই। যেমন জেলখানার সামনে, স্বাধীনতা উদ্যানের পরে আদর্শ শিশু বিদ্যালয়। জেলখানার সামনের রাস্তা দিয়ে আবার মেইন রোডের দিকে হেঁটে গেলে, বাঁয়ে গার্লস স্কুল রোড, পরে অফিসার্স ক্লাব কিন্তু সামনে দেওয়াল নেই। পিছনে অন্ধকার। ক্লাব ভবনও নামমাত্র। এরপর আমলাপাড়ার দিকের রাস্তা। এদিকে গার্লস স্কুলের একটি গেট। অন্যদিকে বাগেরহাট স্কুলের ছোটো গেট। মূল রাস্তায় বাগেরহাট স্কুল, ডানে থানা তারপর সিভিল সার্জন অফিস। এটাই পুরনো হাসপাতাল। একটু এগিয়ে রাস্তা মিলেছে মেইন রোডের সঙ্গে। সেখানে লাশ কাটার ঘর।
এমন একটা এলাকায় সন্ধ্যার পরে কোনও কোনও ছিন্নমূল গৃহহীন মানুষের পদচারণায় দোষ কী। তারা তো সকাল হলে আর থাকে না। যেমন স্বাধীনতা উদ্যানের বেঞ্চিগুলোয় ও রেড ক্রিসেন্ট ভবনের বারান্দায় কেউ ঘুমায়। কেউ না আসুক রহমত পাগল প্রায় দিন রাতে এখানে আসবে। এই ছোট্ট শহরে ভাসমান হিসেবে আবির্ভূত কেউ কেউ রাত কাটাবে এই স্বাধীনতা উদ্যানে। পাশেই পার্কের পুকুর। তার উলটো দিকে মহিলা সমিতির বিল্ডিং, সামনে পিছনে অনেকখানিক ফাঁকা জায়গা, সেখানেও থাকে কোনও ছিন্নমূল। ওই বিল্ডিংয়ের এক কোনায় দেয়াল ঘেষে কেয়ারটেকারের একচালা। এদিকে ডিসির বাড়ি-লাগোয়া ট্রাফিক ব্যারাকের রান্নাঘর। সেখানেও সন্ধ্যার কিছু পরে আর আলো দেখা যায় কই? এই পুরো এলাকা সন্ধ্যার পর থেকেই আধো আলো আধো অন্ধকারে। লাইট পোস্টের আলোও যেন গাছের পাতার সঙ্গে মাখামাখি করে আবছা অন্ধকার হয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকে।
জরিনা রুটি কিনতে গিয়েছিল। একটু পরে হয়তো আজগরই যেত তার সঙ্গে। কিন্তু জরিনা মনে করে, আজগর যেত না। দুপুরবেলার ঘটনার পর থেকে আজগর একটু মন-মরা। যদিও ঠিক ওই সময়ে হয়তো তার মন মরা ভাবটা তেমন ছিল না। বানর দুটোর খাওয়ার জন্যে পয়সা জোটাতে হবে। ইব্রাহিম শেখের মজমা শেষ হলেই সে তাড়াতাড়ি ওই প্রায় ভাঙে ভাঙে আসরে গিয়ে ডুগডুগি বাজাতে থাকে। তার আগে ট্রেজারির সীমানায় কুলগাছে বাঁধা বানর দুটোকে নিয়ে এসে বারিকের বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়েছে ইব্রাহিমের আসরে। ইব্রাহিমের মজমা তখন প্রায় শেষের দিকে।
বারিক বুড়োর তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে জরিনা মুখ টিপে হাসে। চোখের আড়ে একবার আজগরের দিকে তাকায়। চোখ টেপে। আজগর বোঝে জরিনা এই চোখ টেপা দিয়ে কী বোঝাতে চায়। আজগর মাথা নাড়ান, অর্থাৎ নিষেধ করে।