জরিনা ওই কোর্ট চত্বর থেকে একদিন রঙ্গ করতে করতে আজগরের সঙ্গেই সন্ধ্যার পরে থাকবে, দুঃখে প্রাণ কান্দে–এইসমস্ত বলে ওই ঝুপড়ির সামনে এলে আজগর বলেছিল, আচো থাহো। যদি কোনওদিন চইলগা যাইতে মন চায় চইলগা যাবা। কিন্তু কয়দিন থাইয়া ওই ঘর করার বাসনা চোদাবা না।
জরিনাও কি কম যায়। প্রায় লাফ দিয়ে উঠেছিল, কথার কী ছিরি! জীবনে পুরুষ মানষির মুহি এইরাম কতা শুনি নেই। তোমার কাছে আইচে কেডা ঘর করার বাসনা চোদাতি?
হু, হইচে। আইচো তো পিছন পিছান। এমনি মানষির ধারে কও বান্দর নাচাইয়ে খাই নিজের পেট চলে না। আইসকা হাজির হইচো!
আইচি তার হইচে কী, থাকতি দিলি থাকলাম। না দিলি চইলে যাব।
হয় যাইও, যেহানদে আইচো সেইহানে—
কোহানদে আইচি?
আজগরের যেখান দিয়ে আইচো এই কথার ইঙ্গিত জরিনা সহসাই ধরতে পারে। এই যেখান মানে কোন কোন জায়গা তা তার জানা আছে। কিন্তু তখন সে তা জানতে চায়নি। জানতে চাওয়া অপ্রয়োজনীয়। এই যে ওই কথা বলে আজগর বিড়বিড় করল, হয়তো সেই জায়গাগুলোর নামও বলেছে, এর কোনওটাই এখন জরিনার শোনার প্রয়োজন নেই। সে জানতে চায় না। শুধু বলল, থাকতিচে কেডা? ভালো না লাগলি তোমার সাতে কেন রাজপ্রসাদেও মানষি বেশিদিন থাকতি পারে না। থাকপো না, জ্বালাব না, যেরম আইচি এইরম একদিন চইলে যাব। এই দুনিয়ায় থাহার জায়গা আর মানষির কোনও অভাব নেই।
হয়, বারো ঘাট মাড়ানো মানষির থাহার জায়গার কোনওদিন অভাব হইচে?
ফাও কতা কইয়ে না। নিজে কয় ঘাট মাড়ানো?
এসব কথা এমনই। চলতেই থাকে। এ কখনও যেন শেষ হয় না। আগেও হয়নি, এখনও হবে। কিন্তু সেদিন জরিনা আজগরের ওই ছোট্ট ঘরখানির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ওই কথা। বাদর দুটোকে পাশে একটা একচালা টিনের ছাউনির নীচে রেখে, সেখানে শিকলে তালা আটকাতে আটকাতে আরও কথা হয়। কিন্তু আজগরের মতন মানুষেরও মনে ধরেছিল জরিনার ওই একটা কথাই, ভালো না লাগলি মানুষ রাজবাড়িতেও বেশি দিন থাকতি পারে না।
বাঁদর বেঁধে এবার ঝুপড়ির দরজা খুলছে আজগর। সেখানে তালা দেয় না। তালা দেয়ার মতন কিছু নেই। তার সম্পদ বলতে ওই বানর। নিজের ঝুপড়ি ঘরে আর আছেটা কী। একটা লম্ফ আছে, তাও বেশির ভাগ রাতে জ্বালানো লাগে না। একপাশে একখানা লুঙ্গি, প্রায় বোতাম ছাড়া আর একটা জামা। আর, আর প্রায় কিছুই নেই। সেই ঘরের দরোজার সামনের ঠেঙাটা সাটাতে সরাতে আজগর বলেছিল, তাইলে আমারে ভালো লাগে?
অন্ধকার, জরিনার মুখোনা দেয়া যায় না। সেখানে কোনও লজ্জার রেখা পড়ল কি না, তাও বোঝা গেল না। তবে জরিনা আজগরের প্রশ্নের উত্তরে বলে, যা একবার কইচি তো কইচি আর কওয়ার কিছু নেই!
এই কথা কয়দিন আগের? এমন আম পাকা গরমের বেশি আগে তো নয়। তবে, কোর্ট চত্বরের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর তখন ফুল! সেই চত্তির মাসে, আজগরের সঙ্গে জরিনার ওই কথা হয়েছিল! এখনও গরম আছে, জল কাদা বৃষ্টির দিন আসেনি, চৈতা গরমের ভাব এখনও টের পাওয়া যায়।
তবে, সুকুমার আর ঝিলিকের এখানে আসার কারণও জরিনা। এখন এই চারজন আজগরের ওই ঝুপড়ির কাছে, নদীর পাড়ের মাটির রাস্তার উপর বসে আছে, সবটাই জরিনার কারণে। আজগর জরিনার কায়দা-কৌশল কিছুই বোঝে না। এমনকি জানেও না যে, এই যে মেয়েটা ঝিলিক তার সঙ্গে সুকুমারের সম্পর্ক কী। জরিনা তাকে চেনে কীভাবে। সহজ একটা সমাধান অবশ্য আছে, ভিতরে ভিতরে সেই হিসেব করেও রেখেছে, যেমন বলেছিল একদিন স্পষ্ট করে না হলেও প্রায় বিড়বিড়িয়ে। কোন জায়গাদা না কোন জায়গাদা। এই কোন জায়গা আজগর চেনে। এই শহরে ওই জায়গাটা লাইট হলের পিছনে অথবা রেল স্টেশনের কাছ থেকে ধরলে, উত্তর দিকের পুরনো কাপড়ের কলের পাশের পচা পুকুর ফেলে। তারপর মোংলার আছে বানিয়াশান্তা। খুলনায় ভৈরবের ঘাট, যশোরে বাইরে মন্দির। সব জায়গায় আজগর গেছে। ওখানকার মেয়েদের তার চেনা আছে। আর মুখে না বললেও আজগরের মনে হয়, এই দুটোই ওইরম কোনও জায়গা থেকেই এসেছে। দুইজনই আগে থেকে পরস্পরকে চেনে। এখন এই জায়গায় এসে আবার খায়খাতির। আছে কোন বদ মতলবে কে জানে। যেমন, ইব্রাহিমের বছর দুই আগে এইরকম এক মেয়ের জন্যে যে ক্ষতি হয়েছিল, তা সে আজও পোশাতে পারেনি।
অবশ্য, জরিনা কিংবা ঝিলিককে নিয়ে যাই ভাবুক, এসব আজগরের নিজের ভাবনা। এই ভাবনার তো একটা জিনিস আজগরের কাছে স্পষ্ট, সে এখনও জরিনাকে বিশ্বাস করে না। মনে হয় ভিতরে ভিতরে তার কোনও অনিষ্ট সাধনের মতলবে আছে ওই মেয়ে। কিন্তু উপরে যত রাজ্যের পিরিতি!
যাক, আজগর মানুষটাই হয়তো এমন। অল্পে খেপে। চটা বাতিকের। মাথায় সব সময় যেন বায়ু চড়ে থাকে। সেজন্যে কখনও কখনও কথা পুরোটা শোনার আগে খেপে যায়। আজ দুপুরের সুকুমারের সঙ্গে ঘটনাও তাই।
কিন্তু এখন নদীর কূল বেয়ে হাওয়া আসছে। আকাশে শুক্ল পক্ষের চাঁদ। কদিন বাদে পূর্ণিমা। নদীর ওপারের চরগাঁর আকাশ থেকে চাঁদা এখন প্রায় মাঝ নদীর উপরে। নদীতে জোয়ার। পানি ঢুকছে কুলকুলিয়ে। সে শব্দও যেন এখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে। লঞ্চঘাটটা স্থবির। পন্টুনে কোনও মানুষ নেই। সেখানে অন্ধকার। কাল সকালে যে লঞ্চগুলো ছেড়ে যাবে তা বাঁধা। বেশির ভাগই ছোটো লঞ্চ। ঢাকাগামী লঞ্চটা সন্ধ্যার পর-পরই ছেড়ে গেছে। কিছুক্ষণের ভিতরে চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যাবে।