এরপর মোসলেম হাঁটুমুড়ে বসে। ঠোঙা থেকে অর্ধেক পরিমাণ মাটি ঢালে তার সামনের ঘাস ওঠা মাঝখানে দুই-একখানা খোয়াময় ভূমিতে। সেই মাটিতে আধ বোতলের মতন পানি ঢালে। মাটিটা ভালোমতো কচলায়। হাতে চটকে চটকে একেবার কুমরোর মাটি ডলার মতো একেবারে মণ্ড করে ফেলে। আঠালো মাটি, মোসলেমের দীর্ঘদিনের মাটি ডলার অভিজ্ঞতায় সে মাটি বেশ জুতের হয় যেন একতাল ময়দা সে সামনে রাখছে। এবার আবারও দু-হাতের চার আঙুলে টাকাটা উঁচু করে সবাইকে দেখায়।
এ সময়ে মোসলেমের মুখে কথা চলতেই থাকে। কেন টাকাকে সে এমন মাটিতে দিচ্ছে। টাকার ময়লা আসল ময়লা, চোদ্দজনের হাতের ছোঁয়া লাগে প্রতিদিন টাকায়। টাকা যে পরিমাণে ময়লা হয়, এর চেয়ে আর কোনও কিছু এত বেশি ময়লা হয় না। কিন্তু ময়লা টাকারও দাম থাকে। একই। এই টাকাটাকে সে এখন আরও ময়লা করতে মাটির সঙ্গে এইভাবে চটকে দিচ্ছে।
মোসলেম এবার টাকাটাকে ভাঁজ করে মাটির সঙ্গে কচলায়। ভঁজ করতে করতে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণে করে ফেলে। তারপর ওই মাটির গহ্বরে সেধিয়ে রাখে। এমন থাকে টাকাটা কিছুক্ষণ। এই সময় মোসলেম তার জীবনের গল্প বলে। অভিজ্ঞতার কথা বলে। বাম হাত মুছে ঝোলা থেকে বের করে দড়ি-বাঁধা এক তাড়া চিঠি। কারা কারা তাকে প্রশংসা করে চিঠি লিখেছে। চিঠিগুলোর বেশির ভাগই পোস্টকার্ড। যদি সামনের কেউ চায় তো সে পড়ে শোনাতে পারে।
তা কি কেউ চায়? সবাই অপেক্ষা করছে মোসলেমের কাপড় ধোয়া পাউডারের কেরামতি দেখতে! সে ডান হাতটা বোতলের পানিতে থোয়। সামনের ছোটো গামলাটায় পানি ঢালে। এরপর ঝোলা থেকে বের করে মাত্র একটি প্যাকেট। প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া সাদা পাউডার। মোসলেম উদ্দিনের কাপড় ধোয়ায় গুড়ো সাবান! গামলার পানিতে সেই পাউডার ছড়িয়ে দেয় সে। ভালো করে গোলায়। গামলার তলায় এক টুকরো ইটের ঠেক দিয়ে কাৎ করে রাখে। আবার টাকাটা মাটিতে চটকায়। তারপর গামলার পানিতে ছাড়ে। সবাইকে বলে, মাত্তর দুই মিনিট। দুই মিনিট বলে, মোসলেম নিজের বাঁ-হাতে বাঁধা পুরনো ছোট্ট হাতঘড়ির দিকে তাকায়। কিন্তু সমবেত জনতাকে জানায়, এখন দু-মিনিট রাখার প্রয়োজন নেই। এই যে ভালো করে ধুইলাম। ধুতে ধুতে ভাঁজ করা টাকাটা মেলে দেয়। মেলে পানিতে খলবলায়। টানটান করে। ততক্ষণে টাকাটা সত্যি পরিষ্কার। এবার অপরিষ্কার পানি ফেলে দিয়ে, সেখানে আর-একটু পরিষ্কার পানি ঢালে। টাকাটা নাড়ে। অথবা, টাকাটা সেখানে সাঁতরায়। তারপর ঝাড়ে। টাকার গা থেকে পানি ঝাড়ে। তারপর পরনের পরিষ্কার লুঙ্গিখানায় উরুর কাছে কিছুক্ষণ চেপে রাখে। পরিষ্কার লুঙ্গি টাকা গায়ের জল টানে।
এরপর মোসলেম সেই টাকা আবার দুই হাতের চার আঙুলে উঁচু করে দেখায়। সত্যি টাকাটা একেবারে চকচকে পরিষ্কার। একটু ভিজে ভাব আছে, কিন্তু সেই আগেরই টাকা। একেবারে নতুন।
এবার সমবেত জনতার মুখের দিকে তাকানোর পালা। মোসলেম জানাল, তার বলা কওয়া শেষ; যদি আপনাদের বাড়িঘরে জন্যে লাগে, যদি লাগে অফিস আদালতে, সামনের দুজনকে বলল, অপরিষ্কার লুঙ্গি পরলে কী-কী রোগ হতে পারে। কেন তারা এই কাজ করে? মাত্র দুই টাকার একটি প্যাকেটে এক বালতি কাপড় ধোয়া যায়। ক্ষারে সোডায় কাপড়ের চেহারা ভালো থাকে না। যার লাগে জায়গায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিলেই হবে।
অনেকেই দু-টাকা বের করে। কেউ হাতে নেয় চারটি পঞ্চাশ পয়সার রেজগি। মোসলেম লাঠিতে ভর দিয়ে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেয় পাউডার। এই সময়টাই তার সবচেয়ে আনন্দের। আলেকজানের হাতে কেরামতি আছে। সেই আনন্দে মোসলেমের ল্যাংচে-চলা পায়ে একজন থেকে একজনের সামনে যায়।
আজও তো এমন একটি দিনই ছিল। ওই আজগর আর সুকুমার মোসলেমের সেই আনন্দে খচখচানি। নিজেগে মদ্যি কেউ বাধায়? ঝিবুতপালা (ছোটো ছেলেমেয়ে) বেবোধ, বোধ যে কবে হবে। এ কথা ভাবতে ভাবতে সে আলমকে চা দিতে বলে। আর কানখাড়া করে রাখে যদি আশেপাশে কেউ ট্রেনের কেসের কী হল, তা নিয়ে কথা বলে।
সে ভাবে, ট্রেন উইঠে গেলি খবর আছে। সবাই তহোন বাসঅলাগো হাতে জিম্মি! আর কোনওদিন ষাটগম্বুজ যাত্রাপুর মূলঘর ফকিরহাট বাহিরদিয়া সামন্তসেনায় ক্যানভাস কইরে পেটের ভাত জোটাতি হবে না। কোর্ট তো কত কত দিন বন্ধ থাকে, কিন্তু ট্রেন তো চলে সারা সময়!