এবার, এতক্ষণে সুকুমার একটু চঞ্চলতা দেখাল, মোসলেম কাকা, যা কবেন, তাড়াতাড়ি কন। যাই, একদিক দে ঘুইরে আসি
না, কব আর কী? এই জায়গায় নিজেগো এট্টু মিলেমিশে থাকতি হয়, নিজেগো মদ্যি ভুল বোঝাবুঝি হলি মানষি কবে কী?
তা সত্যি।
এ সময় একটু আগে জরিনার হোটেলে দেখা সেই মেয়েটি আসে। মোসলেম মেয়েটিকে চেনে। আগে দেখেনি। মেয়েটি এখানে এসে সুকুমারের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেটাও তার লক্ষ করা হত, যদি জরিনা আজগরের চুলে একটা টান না দিয়ে বলত, ওই যে ঝিলিক আইচে!
তাহলে এই মেয়ের নাম ঝিলিক। এই চত্বরে নতুন। কার কাছে এসেছে, কেন এসেছে, কোথা থেকে এসেছে, মোসলেমের জানা নেই। কিন্তু জরিনার ওই কথা বলায় সে বুঝল, সে আগে থেকেই চেনে। শাড়ি পরা, আঁচল ঘাড়ের কাছে যত্নে তোলা, বেণি দুই দিক দিয়ে ফিতে দিয়ে বেঁধে বেশ ঝুলিয়ে দেয়া, পায়ে মোগল চপ্পল। এ মেয়েও পান খায়!
ঝিলিকের গলার স্বরে একটু মোটা ধাঁচ। শরীরও বয়েসের তুলনায় ভারি। কোথায় যেন দেখানোপনাও আছে। এই এসেই বলল, এহানে হইচে কী?
জরিনা বলল, হবে কী? এমন ভাব করো যেন দারোগা?
শুনে ঝিলিক গলা খুলে হাসল। তারপর বলল, সুকুমার বাঁধাইচে? আজগর ভাইর সাথে? ও যে জায়গায় যাবে!
সুকুমার চারদিক তাকাল। যেন ঝিলিক এখানে না আসায় তার জন্যে ভালো ছিল। সে মোসলেমকে বলল, ও কা, যাই এট্টু অন্য দিক। কাজ আছে, ঘুরে আসি। বারিকদার ওই জায়গায় আমার যন্ত্রপাতি থাকল, আসপ এহোনই
মোসলেম নীচু স্বরে বলল, আচ্ছা।
এবার সুকুমার ঝিলিককে বলল, তুমি যাবা? চলো–
সুকুমারের চলে যাওয়ায় বোঝা গেল, ভিতরে ভিতরে সে নাখোশ। এ নিয়ে অবশ্য মোসলেমের কী-ই বা করার আছে। সে আজগরকে কিছু একটা বলবে ভাবে, কিন্তু কী বলবে। আজগর উঠে জরিনাকে নিয়ে গেল বারিকের দোকানের দিকে। মোসলেম সেদিকে তাকিয়ে থাকল। এখন, আজগর ওখানে গিয়ে বুঝবে আর কতক্ষণে শেষ হবে ইব্রাহিমের মজমা। তারপর একবার তার বাঁদর দুটোর কাছে যাবে। জরিনা হয়তো বসে থাকবে বারিকের সামনে কি পাশে। বারিককে পটাবে, সে পান খাবে কি না। এতক্ষণে জরিনার মুখের পান প্রায় শেষ। কিন্তু ঝিলিক নামের এই মেয়েটিকে কোনওভাবেই চিনল না মোসলেম। এখানে কয়দিন হল এসেছে? সে জানে না। সুকুমারের সঙ্গে তার সম্পর্কে কী? গেল তো একসাথে। ওদিকে জরিনা চেনে ওই মেয়েকে। চিনুক। একটু আগের ঘটনায় মোসলেমের মনটা একটু খারাপ। সুকুমার আর আজগর পরে আবার এনিয়ে এক চোট লাগবে না তো। সুকুমারের ভঙ্গিতে মনে হল, আজ সে আর যাবে না চত্বরে। অথচ যতই গরম পড়ক, এর ভিতরে মোসলেমের যথারীতি একটি দিন শুরু হয়েছিল। কোর্টে উপচানো ভিড়ে সেই মজমার জমায়েতে মানুষও হয়েছিল ভালো। আলেকজান আজ বাজার-সদাইর কথা বলেছে। সে বিকেল হলেই যাবে। যথারীতি শুরু হওয়া একটি দিন হঠাৎ, এত রোদের ভিতরে মরে গেল কেন? পাশ থেকে দুজন মানুষ ট্রেনের কেসের আবার হিয়ারিঙের ডেট পড়িচে বলতে বলতে চলে যায়। সব কথার অর্থ মোসলেম বোঝে না। কিন্তু কোর্টচত্বরে চলে এমন শব্দ কোনটা কোনটা বোঝে। সে ডানে গিয়ে একবার বারিকের বট গাছের নীচে তাকায়। তারপর সোজা মেইন রোড ধরে আবার উকিল বারের সামনে আলমের চায়ের দোকানের দিকে হাঁটে। সেখানে গেলে ট্রেনের ঘটনা জানতে পারবে।
এই পথটুকু যেতে যেতে মোসলেম আবার তার মজমা মিলানোর কথা ভাবে। সেই উঠে যেতে যেতেই তো ইব্রাহিম শুরু করেছিল। তারপর কোন ফাঁকে এসব হল। মোসলেম ভাবে, গোল হয়ে বসে সে আবার আউ-আউ-আউ করার জন্যে ডান হাতের তালু মুখের কাছে ছোঁয়াল। জমায়েত বাড়ছে। অনেকেই জানে মোসলেম কী করে, কী করবে। সঙ্গের পোটলাটা পায়ের কাছে। ধীরে ধীরে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত বলল। তার ভিতরে কোনও কথায় নিজেই হেসে উঠল। কোথায় কোন খান সেনা কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে জামা কাপড় কালো করেছিল, তারপর সে জানতে চেয়েছিল এই দেশে জামা কাপড় কেন পরিষ্কার হয় না। তাই নিয়ে ব্যঙ্গ করল। যদি সে জানত, কবি মাইকেল মধুসূদন বিলাত থেকে জামা কাপড় কাঁচাতেন, কারণ বাংলাদেশে তখনও কাপড় জামা কাঁচার ভালো সাবান ছিল না। সব সোডায় ক্ষারে ধোয়া হত, তার মতন কবি এইসব ক্ষারে কাঁচা জামা-কাপড় পরলে মান ইজ্জত থাকে। সেই যশুরো পাবলিক যদি একদিন এই মোসলেমের পাউডারের খোঁজ পাত, তালি আর যাই হোক কোনওদিন বিদেশে জামা কাপড় পাঠাত না।
এই পর্যন্ত জানিয়ে সে তার কেরামতি দেখানোর জন্যে পোটলায় হাত দিল। বেরুল একটি ছোটো গামলা, এক বোতল পানি, একটি কাগজের ঠোঙায় পরিষ্কার এটেল মাটি। এই মাটি নদীর ওপারের চরগাঁ থেকে আনা। এরপর দর্শকদের কাছে জানতে চাইল, আছে কারও পকেটে পরিষ্কার পাঁচ টাকার নোট। না, থাকুক। মোসলেমের পকেটে মজুদ। কোর্ট মসজিদ রোডের সোনালী ব্যাংক থেকে সপ্তায় সপ্তায় সে আনে, কোনও দোকানে পেলে সংরক্ষণ করে। সেই টাকার একটি এবার মোসলেম তার পকেট থেকে বের করে। প্রায় চতুর্দিক ঘুরিয়ে সবাইকে দেখায়। বসা থেকে লাঠিভর দিয়ে উঠে দুই-একজনকে ধরে দেখতে বলে, টাকাটা আসলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কি না। আর কী পরিষ্কার, একেবারেই নতুন। সে জমায়েতকে জানায়, কিছুক্ষণ আগে সে কোর্ট মসজিদ রোডের সোনালী ব্যাংক থেকে এনেছে।