না, কোনও জায়গায় যাতি হবে না। আজগর বলে, আপনার ধারে এট্টা বিড়ি থাকলি দেন। এই আবালের কাটাবাড়া সুকুমারের সাতে এহোন এট্টা বোঝাঁপড়া কইরগা সেইয়ার পর এইহানদা যাব–
হইছে। জরিনা আজগরকে বলল, হইচে সুকুমারদার সাতে আর অত বোঝাঁপড়া দিয়ে কাজ নেই?
কেন? বালডা কয়দিন আইসেই এহোন এইসব উলটো পালটা কইতেছে, এইয়ার পর আমাগো সবাইর মাতায় হাগবে। শালা রামপাইলে মাল, ও পদই আলাদা
মোসলেম বুঝল, কথাবার্তা উলটো পালটা হচ্ছে। সুকুমার এমনিতেই একটু মিইয়ে গেছে। বিষয়টা যে সে ঠিক বলেনি, তা বুঝতে পারছে হয়তো। অথবা, ভিতরে ভিতরে অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে, যেজন্যে সুকুমার ইচ্ছে করেই আজগরকে ওই কথা বলেছে। সুকুমার চারদিকে লোকজন দেখে আর জরিনা আজগরের কাছে এলে, একটু গলা নামিয়ে সেই কথা বলল; আসলে মোসলেমের দিকে তার নজর, যেন এই কথাগুলো মোসলেমকেই বলা যথাযথ, আমি আসলে ওরে কতি চাইলাম, ইব্রাহিম ভাই হইয়ে গেলি ও যেন এট্টু ডুগডুগি বাজাইয়ে উইঠে যায়। তারপর আমি খেলা দেখাব, আসলে আইজকে কোর্টে ওই রেল লাইন নিয়ে কে এইসমস্ত আছে, শহরের লোকজন সব গাদানো, এট্টু বাদে সব ফাঁকা হইয়ে যাবে।
তুই সেইয়া কইস নাই, তুই কইচিস এহোন ইব্রাহিমের ওই পাশে যাইয়ে, এহোনই খেলা দেহাইতে
তুমি আমার কতা শুনিছো? পাত্তা দিচো আমার কতায়? সেয়ার আগেই তো আমারে প্রায় এইহেনদে বাইর কইরে দেয়ার দশা!
তা তুই ওইরাম কতা কইচিস কে?
আমি কী কতি চাইচি আর তুমি কী কইচো, এট্টু ভাইবে দেইহো–
হইচে–দেহিচি–তুই জানো না, ইব্রাহিম যখন ক্যানভাস করে, তহোন আর কোনও খেলা চলে না, তা কোর্টে যতই ভিড় থাউক। বলে সে সামনের দিকে নির্দেশ করে, দে, চাইয়ে দেখ্, ইব্রাহিমের ওই জায়গায় কী ভিড়! যদিও মোসলেমের জানা আছে সুকুমার খেলা দেখানোর সময়ও দারুণ ভিড় হয়।
জটলা ইতিমধ্যে ফেটে গেছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু যতই ফাটুক, মোসলেমের কাছে সুকুমার আর আজগরের বিষয়টার আসলে কোনও সমাধান হল না। ইব্রাহিম শেখের ক্যানভাস আর কিছুক্ষণের ভিতরে শেষ হবে। তখন কে যাবে? তাছাড়া এই মনমালিন্য কাজিয়া-বিবাদ নিয়ে এক জায়গায় কাজ করা যায়? প্রতিদিন সকাল হলে একে অন্যের মুখ দেখো, বিকেলে দেখো, নিজেরদের হিসেব নিজেদের মিলিয়ে নিয়ে চলতে হয়। রাত হলেও তো পরস্পরের মুখ দেখে আজগর আর সুকুমার। মোসলেমের নাহয় মুনিগঞ্জে বাসা আছে, নদীর ওপার বাদোখালি গ্রামে বাড়িও আছে, কিন্তু আজগর আর সুকুমারের রাত্রে মাথা গোঁজার ঠাঁইও তো এই চত্বর। নাকি অন্য কোথাও থাকে তারা। দেখেছো, এতদিন একসাথে চলেও মোসলেমের যেন জানা হয়নি কে কোথায় থাকে। না, আজগর থাকে ওই লঞ্চঘাটের দিকে নদীর কূল বেয়ে কিছু দূর হেঁটে গেলে একখানা দোকানঘরের পিছনে ছাপড়ায়, কিন্তু সুকুমার? সত্যি মোসলেম তা জানে না।
মোসলেম পাতলা হওয়া ভিড়ে এবার সুকুমারের কাছে এগোয়। এদিকে জরিনা আজগরের পাশে দাঁড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটতে শুরু করেছে। আজগর বসা। মোসলেমের কাছে থেকে একটা বিড়ি নিয়ে ধরিয়েছে সে। সামনের দুটো দাঁত নেই। চুলগুলো উসকোখুসকো, যেন কতকাল ওখানে কোনও সাবানের ছোঁয়া পড়েনি। পড়লেও ওই চুলের তেমন কোনও পরিবর্তন নিশ্চিত হবে না। দাঁত নেই তাতেও আজগরকে মানিয়ে যেত অথবা মানিয়ে গেছে, কিন্তু সেই দাঁতের যা ছিরি! লাল হয়ে আছে, দুটো দাঁতের মাঝখানের ফাঁকগুলো কালো, কোথাও কোথাও খাবারের কণা। আরও আছে। গায়ের রং। একেবারে তেঁতুলের বিচি! হতেই পারে, কিন্তু মানুষ তা একটু ধোয় মোছে যত্ন করে। দিনের ভিতরে একবার নদীতে ডুব দিলে নাওয়া হল, সেইটুকু করতেই যেন আজগরের কত কষ্ট। না, তাও বলা ঠিক হল না, আজগর আসলে অমনই। মানুষ নয়, সেও নায়। সেই কাজটি কখনও মনোযোগ দিয়ে করেছে বলে মনে হয় না। সে তুলনায় তার বানর দুটো পরিষ্কার। ওখানে তার যত্নআত্তি ষোলোআনা। এই লোকের সঙ্গে জরিনা যে কী করে থাকে? মোসলেম অবশ্য অত শত ভাবে না। তবে এটা ভাবে, জরিনা মেয়েটা রং-ঢং জানে ভালো। সাজে সুন্দর করে। দেখো, এতক্ষণে প্রায় দুপুর এগিয়ে আসছে, মানুষের গালেমুখে ঘাম, সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে অথচ জরিনার চেহারা দেখলে কে তা বলবে। মনে হবে একটু আগে আজগরের ছাপড়া থেকে সেজেগুঁজে বেরিয়েছে। তারপর জানে, কোন সময় তারে কেমন দেখায়। এই যে একটু আগে মোসলেমের সঙ্গে খাওয়ার পর এক খিলি পান মুখে দিল, এখন ঠোঁট দুটো কেমন রাঙা লাল। যদিও যে আজগরের জন্যে ওই ঠোঁটখানা সে লাল করেছে, সে কিন্তু সুকুমারের সঙ্গে ঝগড়ার পরে ওই যে বসেছে, তারপর আর একবারও মাথা তুলে দেখেনি।
তবে, জরিনার একটা বিষয়ে মোসলেম খুব অবাক! দাঁড়িয়ে আজগরের মাথায় হাত দিয়ে চুলে বিলি কাটছে ঠিকই, কিন্তু একবারও সুকুমারের দিকে তাকিয়ে চোখে কোনও কটাক্ষ করছে না। বরং, মাঝখানে একবার বলেছে, নতুন মানুষ, এই জায়গার নিয়মকানুন এট্টু জাইনে চলতি হয়, হু। তারপর সুকুমারের দিকে তাকিয়ে বেশ মুচকি এক হাসি।
মোসলেম বলল, তা কী সিদ্ধান্ত হল?
আজগর বলে, সিদ্ধান্ত আর কী? ওর কথায় হবে নাকি?
সুকুমার সরে যেতে থাকে। যেন, এখন এখান থেকে যেতে পারলে হয়। আবার দাঁড়াল। যেন, মোসলেম গুরুজন, মুরুব্বির সিদ্ধান্তের এক সম্মান আছে। কিন্তু সুকুমার তো তার ভুল স্বীকার করেই নিয়েছে। বলেছে, ইব্রাহিমের পর পর আজগর একটুক্ষণ যদি ডুগডুগি বাজায় তাহলে লোকজন আর যাবে না, তখনই সুকুমার সেই আসরে ঢুকে পড়বে। আজগরের আজ আর খেলা দেখাতে হবে না। তার বিষয়টা সুকুমার পুষিয়ে দেবে। কিন্তু সেই কথাটাও যেন আজগরের সামনে। তোলা যায়নি, তার আগেই খেঁকিয়ে উঠেছে। এখন আর ওই কথা বলে লাভ কী? সুকুমার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, আজ আর সে যাবে না ওই চত্বরে। মনে কোনও উচাটন টেনশন আর দোটানা অথবা মন খারাপ নিয়ে কোনওভাবে তিন ফলকের খেলা দেখানো যায়?