মোসলেম হেসেছে। হেসেছে তারা দুজন। তবু কিন্তু মোসলেমের জানতে চাওয়ার সেই রহস্য শেষ হয় না। সত্যি সুকুমার ছেলেটা কিছু হলেও শিক্ষিত, একটু হলেও স্কুল-কলেজে গেছে। যদি কলেজে নাও যায়, হাই স্কুলে গেছে নিশ্চয়। মোসলেম সেকথা আবার তুলেছে, ক দেহি, তুই কোন পর্যন্ত পড়িচিস?
বাদ দেন। বাদ দেন দি ওইসমস্ত। এহোন খেলা দেহাই, পেট চালাই–বাড়িঘর কোথায়ও তাও ভুলে যাতি চাই–এই কোর্টর সামনে জীবন। এই জায়গায়ই একদিন জীবন শেষ হবে। তারপর গলা না-তুলে গান গায়, এই পথেই জীবন, এই পথেই মরণ আমাদের, সবকিছু পথেই যে হায়
মোসলেম শুনল, সুকুমার ছেলেটার গলায় সুরও আছে। এমন ছেলে, কার ছেলে, কোথায় বাড়িঘর, দেখো এইখানে এভাবে জীবন চালায়। মোসলেম একটু বিস্ময়ের সঙ্গে সুকুমারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
সেই সুকুমার আর আজগরের ভিতরে এক প্রহর বেলা না যেতেই কী আর এমন ঘটল যে এইরকম ঝগড়া হবে। হয়তো আর একটু হলে প্রায় হাতাহাতিই হত। আবার তা নাও হতে পারত। আজগর শারীরিকভাবে দুর্বল, বয়সে সুকুমারের চেয়েও বড়ো। সুকুমার দীর্ঘদেহী, আজগর সে তুলনায় খাটো। এক্ষেত্রে সুকুমার যদি গায়ে হাত না তোলে, আজগরের দিক থেকে সেই সম্ভাবনা কম। আবার সুকুমার সে কাজ করবেও না। কেননা, এই কয়েকদিন হল সে এসেছে এখানে, এখনই এমন কাজ করে এই কোর্ট চত্বর থেকে চলে যাবে নাকি? তারপর যাবে কোথায়? রেল স্টেশনে? স্টেশনে একেবারে পুব কোনায়, যেখানে পুরনো কাপড়ের কলের কাঠামো এখনও আছে, তার পাশে যতটুকু জায়গা, সেই ফাঁকা জায়গায় বিকেলের আগে লোক জমায়েত তেমন হয় না। একমাত্র ইব্রাহিমই সেখানে মজমা মিলিয়ে যদি দুই-চাইর পয়সা কামাতে পারে, সুকুমারের খেলা দেখার লোক সেখানে কোত্থেকে আসবে। মোসলেম এই কদিনে ভেবেছে একবার কোনও সুযোগে সুকুমারের কাছে জানতে চাবে, সে সার্কাসে যায় না কেন? কিন্তু তেমন সুযোগ ঘটেনি।
এখন জরিনাসহ সেই ছোট্ট জটলার পাশ ফুড়ে মোসলেম ঢুকে যায়। বলে, তোগে হইচে কী? এই বিলে চেঁচাতিস কী জন্যি?
আজগর বলল, হবে কী বাড়া? এই চোদ্দনা কোহানদে আইসে জুটিচে?
কেন হইচে কী?
আমারে কয় বেলা চইড়ে যায়, তুমি যাও, যাইয়ে ইব্রাহিমের পাশে এহোন বান্দর নাচাও! তাতে সমস্যা কী?
আপনে আবার বাতাস দিয়েন না। হবে কী জানেন না? ইব্রাহিমের ক্যানভাসের সোমায় কার বালের দায় পড়চে আমার খেলা বান্দরের খেলা দেকপে?
কথা সত্যি! ইব্রাহিম যখন সাপে-কাটা মানুষকে কীভাবে বাঁচানো যায়–এই ক্যানভাস করে, সেখানে ভিড় উপচে পড়ে, তখন কি বানরের খেলা দেখানোর একটা সময় হল? বরং সে সময় চত্বরের পশ্চিম পাশের জায়গা ফাঁকাই থাকে। বারিকও প্রায় ঝিমায়। তার একটু সামনে ইব্রাহিমের মজমা। যত ধরনের বই-ই বারিকের কাছে থাক, সহজ সবজি চাষ কি বেয়ানের সঙ্গে একটি মাধবী রাত আর চন্দ্রনাথ কি দেবদাস, চিতা বহ্নিমান কি বাংলাদেশ রক্তের ঋণ কিংবা আমি মেজর জিয়া বলছি–কোনওটাই কেউ হাতায় না। ফলে, বারিকের ঝিমানো ছাড়া আর কী উপায় থাকে?
তালি সমস্যা কী? তুই গেলি না। সেই জন্যি ঝগড়া বিবাদ করতি হয়?
আজগর বলে, কইলাম, ইব্রাহিমের খেপ শেষ হইলে সেইয়ার পর আমি যাই। বেশিক্ষণ থাকপ। বান্দর দুইটে কহোন বাইন্দে রাহিচি ওই ট্রেজারির ধারে কুল গাছে। সেইয়ার পর সুকুমার যাবে। ও কয়, না, ও যাবে। ইব্রাহিম সইরে যাইতে যাইতে মানুষ থাকপে ভালো, তখন ওর খেলা দেহাইতে সুবিধা। শোনেন কতা?
মোসলেম আজগরের খেপার কারণ বুঝতে পারে। সে সুকুমারের মুখের দিকে তাকায়। আশেপাশে যেসব লোক, তারা কেউই ক্যানভাসার গোত্রের না। তবে, কোর্ট চত্বরে বিভিন্ন কাজে আসে এমন অনেকেই আছে। তারা কেউ কেউ ঝগড়াটা শুরু থেকেই দেখেছে। অথবা তারা ঝগড়াটা দেখেই গেছে, হয় বুঝতে পারেনি কী নিয়ে ঝগড়া অথবা এই বিবাদের কোনও শালিস করতে চায়নি। এমনিতে বেশির ভাগ মানুষেরই এই এক সমস্যা, কাজিয়া-বিবাদ দেখলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, ফ্যাল ফেলিয়ে হাসে, কোনও ধরনের সমাধানের দিকে তারা যায় না। ঝগড়া ফ্যাসাদ কার পছন্দ? কিন্তু এইসব মানুষের অনেকেই তাতে যেন বেশ উৎসাহ পায়। তাছাড়া এই কোর্ট চত্বরে আজগর বানরঅলা আর সুকুমার খেলাঅলা হিসেবে কিছুটা হলেও পরিচিত। তাদের দুজনের এই ঝগড়া অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে, তাতে আর অবাক হওয়ার কী আছে?
মোসলেম এই পহেলা হাঁক দিল। গলা তার তেমন ওঠে না। সে তো কোর্টের সামনের এক ক্যানভাসার। একেবারেই গলা ওঠে না, একথা কীভাবে বলা যায়? হাঁকটা দিল ভিড়টা পাতলা করে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু অনেকেরই পরিচিত এই দুজন মানুষের কাজিয়ার কোনও সমাধান না-হলে তারাও-বা সরে যায় কী করে? তবু, প্রায় ঘণ্টাখানেক ক্যানভাস করার পর গলায় আর জোর থাকুক কি চাই নাই থাকুক, মোসলেম সবাইকে জানাল, দেহি তফাৎ যান, তফাৎ যান, এই দুজনের ঘটনাডা আমারে এট্টু বুঝদি দেন–
তাতেও কিন্তু জনতার কোনও ভাবলেশ দেখা গেল না। তারা সরল না। এক একজন প্রায় কারেন্টের খাম্বার মতন দাঁড়িয়ে থাকল। মোসলেম আর গলা তুলল না। বরং, উলটো ঠেলা দিল। সে জরিনাকে বলল, এ জরিনা, তুই আজগররে নিয়ে এইহেনদে সইরে ওই বারিকের দোকানের ওইদিক যা, আর নয় ওই হোটেলে যা। ওই জায়গায় তোর চেনা আর এক ছেমড়ি আছে আসার সময় কতিলি, সেইহানে যাইয়ে বয়।