- বইয়ের নামঃ ডুগডুগির আসর
- লেখকের নামঃ প্রশান্ত মৃধা
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত
মোসলেম উদ্দিন পোশাকে সবচেয়ে ধোপদুরস্ত। তা তো তাকে হতেই হবে, কাপড় ধোয়ার পাউডার বিক্রেতা বলে কথা। লন্ড্রিতে থোয়া ইস্তিরি করা ক্রিজ তোলা সাদা জামা আর ঈষৎ পরিষ্কার নীলাভ লুঙ্গি না-পরে উপায় আছে, কেউ কিনবে তার পাউডার!
এই যে সকাল দশটা নাগাদ মোসলেম উদ্দিন কোর্ট চত্বরে এল, যেন মঞ্চে এক প্রবীণ অভিনেতার প্রবেশ। সিনেমায় এমন হলে দর্শকরা ক্লাপ দেয়, নায়কের উদ্দেশে চোখা ডায়লগ ছাড়লে শিস দেয় কেউ, মঞ্চে থাকলে বড়ো চোখে ঘাড় উঁচু করে দেখে। কিন্তু মোসলেম উদ্দিনের উদ্দেশে এখন ঘটবে না। এক পায়ে কবে কোন আদ্যিকালের পলিও নিয়ে ল্যাংচে একখানা ছোট্ট লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটার শুরু। উকিল মোক্তার পেশকার নাজির এমনকি মুনসেফ ম্যাজিস্ট্রেট ডিসি এসপির সামনে ভিড়ের ভিতর দিয়ে যতই ধোপদুরস্ত হয়ে মোসলেম হেঁটে আসুক না কেন, চত্বরের মেহগনি আর মেঘনিশ গাছটার নীচে এসে আসর জমানোর আগে তার একটিও ক্লাপ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কে দেবে এখন হাতে তালি। সবাই সামনের মজমায় বিভোর! যদিও সে জমায়েতের সবারই এখন হাত মুঠ-ছাড়া। মুঠ করা যাবে না, পকেটে হাত দেয়া বারণ, লুঙ্গির কোচড়েও না। ওই মজমাঅলার অনুরোধ, হাত দেয়া যাবে না হোলে আর গালে!
ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে মোসলেম উদ্দিন মেঘনিশ গাছটার নীচের দিকে যায়। সে এসেছে উত্তর দিকের রেজিস্ট্রি অফিসের ছোটো ঘরটার কাছে থেকে। তারপর মূল কোর্ট বিল্ডিঙে পিছনের বার কাউন্সিলের পাশের ছোটো মাঠে বসে একটা বিড়ি ধরিয়ে টানছিল। সঙ্গে পোটলা-পুটলিভরতি জিনিসপত্র আরও আগে মেঘনিশ গাছের নীচে রেখে গেছে। সেখানেই প্রতিদিন সকালে রাখে। সে একলা না, সাপ খেলার বাকসো, মহাশংকর তেল বিক্রেতার জিনিসপত্র, একশ এক পদের ধন্বন্তরি গাছ-গাছড়া, ওই পাশের নীচু বটতলার বই বিক্রেতাও এখানে রাখে তাদের জিনিস। শুধু বানর খেলা দেখানো আজগর কখনও বানর দুটোকে এখানে বাঁধে না। তা সে বাঁধে ওই ট্রেজারির কাঁটাতারের পাশের ছোটো কুল গাছের কাণ্ডে। ওখানেই ও দুটো ভালো থাকে। এখানে গাছের গুঁড়ি মোটা, আজগরের বানরের গলার চেইন অত বড়ো না, তাছাড়া গুছিয়ে রাখা এসব জিনিসপত্রের পাশে বানর দুটোকে রাখলে বাঁদরামির অন্ত থাকবে না। ইদানীং মর্দাটার পিঠের লোম কমতে শুরু করেছে, সেখানে বাঁদরামির জন্যে দু-ঘা দিতে আজগরের আজকাল কষ্ট হয়। শত হলেও অবলা প্রাণী, তার পেটের ভাত জোগায়।
মোসলেম উদ্দিন বার কাউন্সিলের কোনায় নীচু চিলতে কোর্ট বিল্ডিঙের দিকে যাওয়া ছাউনি দেওয়া সরু পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে চত্বরের সামনে খেয়াল করল। এখনও লোক সমাগম কম। আকাশ পরিষ্কার। যদিও একটু গুমোট ভাব আছে। দক্ষিণে নিম্নচাপ-টাপ হল না তো? তা হতে পারে। কাল সন্ধ্যা থেকেই বাতাস কেমন যেন একটু আটকানো আটকানো। কিন্তু সন্ধ্যার পর পরই আকাশে তারা উঠলে সে বুঝেছিল, দক্ষিণে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেনি। যদিও তখন নারকেল গাছের পাতায় পাতায় বাতাস খেলে যাচ্ছিল, এমনভাবে যেন নারকেল গাছের পাতাগুলো পরস্পরের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে শব্দ করছে। সে শব্দ শুনতে ভালো লাগে মোসলেমের। হাতে তখন তার ছোট্ট বাজারের থলি। সে নাগেরবাজার থেকে হেঁটে মুনিগঞ্জের দিকে রওনা দিয়েছে। আকাশে ঝুঁকে ঝকে তারা, অথচ গাছের পাতায় বাতাস। সেই বাতাস কোনওভাবেই নীচের মাটিতে আসছে না। রাহাতের মোড়ের পরে কোর্ট এলাকা তারপর পোস্টাপিস ও থানা ছাড়িয়ে মেইন রোড ধরে লাশকাটা ঘরের সামনে আসলে, তখন ডান দিকে নদীর কূল থেকে বাতাস তার গায়ে এসে লেগেছিল। এতটা পথ তাহলে বাতাস ছিল আকাশে। নাকি লাশকাটা ঘরের কাছেই বাতাস নীচু হয়ে এসেছে?
তবে যাই ঘটুক, ওই বাতাস গায়ে লাগামাত্র মোসলেম উদ্দিন একবার পাশের বাড়িটার সীমানায় পাশাপাশি লাগোয়া দুটো নারকেল গাছের পাতায় তাকায়। সে গাছের পাতা স্থির! অথচ তার গায়ে বাতাস। লাঠিটা ধীরে ঠুকে ঠুকে হাঁটে সে।
মুহূর্তে, অনেক দিন আগে একবার বাদোখালি গ্রামের ভিতর দিয়ে তার বড়ো বোনের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা মনে পড়ে মোসলেম উদ্দিনের। অল্প বয়েস। দলবেঁধে যাচ্ছিল তারা। হঠাৎ এমন বাতাসে পাশের নাকি কোনও এক শ্মশান থেকে একখানা সাদা কাপড় উড়ে যেতে দেখেছে তাদের একজন। ভর সন্ধ্যায়, ওই সাদা কাপড় নাকি ভূতে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাকি সবাই দৌড়ে সামনের দিকে যায়। কিন্তু মোসলেমের হাতে ছোট্টো লাঠি, সে পা ল্যাংচে এগোয়। দেশ তখন কেবল ভাগ হয়েছে। এদিকের গ্রামগুলোয় একের পর এক হিন্দু বাড়ি। পাশেই শ্মশান। সেখান থেকে অমন এক খণ্ড কাপড় উড়তেই পারে। কিন্তু সেই কাপড় খণ্ডকে ভূতের কারবার ভেবে ভয়ে বাকি সবাই মোসলেমকে ফেলে ওভাবে এগিয়ে যাবে! গিয়েছিল। সে হাতের লাঠিসহ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সাদা কাপড়খানার উড়ে যাওয়া দেখেছে। এমনকি তার মনে হয়েছিল, ওখানা শ্মশানে পড়ে থাকা কোনও বুড়ো মানুষের কাপড়, ওর সঙ্গে ভূতের কোনও সম্পর্ক নেই। আর এই যে তার জন্যে দাঁড়াল না কেউ, সবাই দৌড়ে গেল, সে বুঝল, এই শরীরে সারাটা জীবন মোসলেম একা। এমন তার আগেও মনে হয়েছে, ওই দিন আবার মনে হয়। তখন আশেপাশে নারকেল গাছগুলোর মাথায় ছিল অমন বাতাসের দোলা, কিন্তু ওই কাপড়খানা যখন উড়ে যাচ্ছিল তখন তার যে গায়ে বাতাস লেগেছিল, মোসলেমের মনে হয়েছে, বাতাস আসলেই নীচু হয়ে আসছে। কিন্তু যতই নীচু হয়ে আসুক, নারকেলের পাতার সেই জড়াজড়ি করা শব্দটা বহুদিন তার কান থেকে যায়নি।