কোথায় সে পত্রের তাড়া ছিল আমার নিকট অবিদিত নহে। তথাপি আমি এদিক ওদিক অনর্থক অনুসন্ধান করিয়া যেন সে পত্রগুলির বিষয় কিছুই জানি না এইরূপ ভান করিয়া কতক্ষণ পরে পত্রগুলি বাহির করিয়া তাহার হস্তে দিয়া বলিলাম, ‘এই পত্রগুলি কি তোমার?’
‘হাঁ – হাঁ এই বটে; যেমন আমি পত্রগুলি বাঁধিয়া শোভনার হাতে দিয়াছিলাম ঠিক তেমনিই আছে।’
আমি আর তাহার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিলাম না; পাছে সে আমার মুখ চোখের ভাব দেখিয়া বুঝিতে পারে যে সেই সকল পত্র খুলিয়া পাঠ করিয়াছিলাম। আর আমি সেখানে দাঁড়াইতে পারিলাম না, মাথা যেন কেমন ভারী হইয়া উঠিল – ঘুরিতে লাগিল। শয্যায় গিয়া শয়ন করিলাম। আপনার হাতে মাথার চুল ছিঁড়িতে লাহিলাম, বক্ষে করাঘাত করিয়া প্রাণের ভিতর যে হাহাকার পড়িযা গিয়াছিল, তাহা দমন করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলাম। তখন বিধবা চলিয়া গিয়াছে।
সেই থেকে এই যন্ত্রণার আরম্ভ। যদিও তখন সেই রক্তবিন্দু শুকাইয়া উঠিয়া গিয়াছিল – বাহিরের যন্ত্রণার কোন চিহ্ন প্রকাশ্হ পায় নাই। তথাপি সেই রক্তবিন্দু যেখানে লাগিয়াছিল সেখানে ভীষণ যন্ত্রণা হইতে লাগিল। বোধ হইল কে যেন গলিত সীসক ঢালিয়া দিয়াছে। প্রতি দণ্ডে যন্ত্রণা ভীষণ হইতে ভীষণতর হইতে লাগিল। সহস্র চেষ্টায় ঘুমাইতে পারিতাম না। তেমন দারুণ যন্ত্রণা বুঝি পৃথিবীর্তে আর নাই। এ যন্ত্রণার কথা আমি কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে ভরসা করিতাম না – কে বিশ্বাস করিবে? আমি কিরূপ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছিলাম আপনি তাহা অবগত আছেন। দুইবার সে প্রাণান্তক যন্ত্রণা হইতে আমাকে নিস্তার করিয়াছেন। কিন্তু যতই সেই ক্ষতস্থান শুকাইয়া আসে ততই যন্ত্রণার বৃদ্ধি হইতে থাকে। দারুণ যাতনায় একহন আমাকে বড়ই অস্থির করিয়া তুলিয়াছে। সহ্য করিবার ক্ষমতাও আর নাই – বোধ হইতেছে এক দণ্ডের মধ্যেই আমাকে ইহলোক ত্যাগ করিতে হইবে। এই আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইতেছে বুঝিয়া মনে মনে আমি সুখী। আশা আছে ইহলোকে পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইয়া গেলে পরলোকে শোভনা আমাকে মার্জনা করিলেও করিতে পারে। আপনি আমার যে উপকার করিয়াছেন তজ্জন্য আপনাকে সহস্র ধন্যবাদ দিতেছি। কৃতজ্ঞের নমস্কার জানিবেন। ইতি –
শ্রীরমেশচন্দ্র বসু
দুই তিন দিন পরে কয়েকখানি সংবাদপত্রে দেখিলাম যে রমেশচন্দ্র বসু নামক এক ব্যক্তি নিজের মাথা দেয়ালে বারম্বার আঘাত করিয়া আত্মহত্যা করিয়াছেন। তন্মধ্যে কেহ কেহ লিখিয়াছেন, পত্নীশোকই রমেশ বসুর আত্মহত্যার একমাত্র কারণ। যাঁহারা একটু সন্ধান রাখিয়াছিলেন, তাঁহারা, দুরারোগ্য ক্ষতরোগের যন্ত্রনাই আত্মহত্যার একমাত্র কারণ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যাঁহারা তাঁহাকে বিশেষরূপে চিনিতেন তাঁহারা প্রকৃত সংবাদই লিখিয়াছিলেন যে, তিনি পাগল হইয়া গিয়াছিলেন, দুরারোগ্য ক্ষতরোগ সেই ক্ষিপ্তাবস্থার একমাত্র খেয়াল ব্যতীত আর কিছুই নহে।