পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পত্র শেষাংশ
শোভনার ফিরিতে সন্ধ্যা হইল।
সর্বাগ্রে শোভনা আমার নিকট ছুটিয়া আসিল; যেন সে আমাকে কতদিন দেখে নাই, তই আমার মুখপানে কতক্ষণ অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল। আমাকে দেখিয়া সে যেন কত সুখী হইল। আমি তখন আপনার মনোভাব একেবারে গোপন করিয় অন্যান্য দিবসের ন্যায় কথোপকথন করিতে লাগিলাম। কিন্তু এদিকে প্রাণের ভিতর বিষের হল্কা ছুটিতেছিল; সে তাহা বুঝিতে পারে নাই।
রাত এগারটার পর উভয়ে শয়ন করিলাম। আমার চক্ষে নিদ্রা নাই – হ্রদয়ে শান্তি নাই; শয্যা কণ্টকাকীর্ণ বোধ হইতে লাগিল। সেই কণ্টক শয্যায়, জ্বালাময় অবস্থায় রাত একটা বাজাইলাম – চক্ষে নিদ্রা নাই। নিদ্রা? সে আশা বৃথা।
আর আমি থাকিতে পারিলাম না; যত রাত বাড়িতে লাগিল ততই সে অন্তর্দাহ সেই সঙ্গে আরও বাড়িতে লাগিল – ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। যখন রাত দুইটা সেই কণ্টকশয্যা ত্যাজিয়া উঠিলাম। উঠিয়া আগে প্রদীপ জ্বালিলাম। দেখিলাম, শোভনা নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছে। দুগ্ধশ্বেত উপাধানে তাহার সেই সুন্দর মুখমণ্ডল পরম শোভাময়। শুভ্র মেঘখণ্ডের বুকে যেন কোন দেবীমূর্তি চিত্রিত রহিয়াছে। বুঝিলাম না – বুঝিতে পারিলাম না – চেষ্টাও করিলাম না। প্রকৃতির এমন নির্দোষ সৌন্দর্যরাশির মধ্যে নরকের পাপের ছায়া কোথা হইতে আসিয়া মিশিল! স্থির করিলাম, শোভনাকে সেই রাত্রেই হত্যা করিব; তাহার সেই নিদ্রিত অবস্থায় তাহাকে হত্যা করিবার জন্য শাণিত ছুরিকা বাহির করিলাম। বাহির করিয়া তাহার সেই কমলকোমল কণ্ঠে বসাইতে গেলাম। হাত কাঁপিয়া কাঁপিয়া চুরিখানা গৃহতলে পড়িয়া গেল। একবার ভাবিলাম, কেমন করিয়া সেই নবনীকোমল কণ্ঠে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করিব। যাহাকে এতদিন নিজের অপেক্ষা অধিক ভালবাসিয়া আসিয়াছি, যাহার সুখ বিধানের একদিন প্রাণপণ করিতে পারিয়াছি আজ তাহাকে কেমন করিয়া এ সংসার হইতে বিদায় করিব? তখন আবার সেই পিশাচের মোহমন্ত্রে মোহিত হইলাম – সে যেন আমার চক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বিদ্রূপের মৃদু হাস হাসিতে হাসিতে বলিল, ‘কাপুরুষ, সাহস নাই।’ সেই কথা গম্ভীর নাদে তখন হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে ছুটিতে লাগিল। আমার বিকৃত মস্তিষ্ক আরও বিকৃত করিয়া তুলিল। তখন অতি সাহসে বুক বাঁধিযা আবার সেই শোণিত-তৃষ্ণার্ত লৌহময় নির্দয় ছুরি দৃঢ় মুষ্টিতে তুলিয়া লইলাম। দৃঢ় মুষ্টিতে ধরিয়া অকম্পিত করে নিদ্রিতা শোভনার সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত করিবার জন্য তাহার বক্ষে আমূল বিদ্ধ করিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই অজস্রধারে রক্ত ছুটিতে লাগিল – স্থির দৃষ্টিতে তাহাই আমি দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তখন একবার যন্ত্রণায় শোভনা ছটফট করিয়া উঠিল। চক্ষুরুন্মীলন করিয়া স্থির দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ আমার দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু সে দৃষ্টিতে ক্রোধের কোন চিহ্ন ছিল না। তাহার দৃষ্টিতে কখনও ক্রোধব্যঞ্জক চিহ্ন দেখি নাই – আজিও দেখিতে পাইলাম না। দেখিতে দেখিতে শোভনার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল। তখন আমার হাতের উপর শোভনার একবিন্দু রক্ত পড়িয়াছিল। কোথায় পড়িয়াছিল তাহা আপনি জানেন। সে রাত্রে আমি সে রক্তবিন্দু দেখিতে পাই নাই, পরদিন দেখিলাম, একবিন্দু রক্ত আমার হাতের উপর শুকাইয়া রহিয়াছে।ব
যে কৌশলে আমি নিজের অপরাধ গোপন করিয়াছিলাম তাহা আপনাকে জানাইতে চাহি না। আইনের হাত এড়াইলাম বটে, কিন্তু ঈশ্বর যে উপরে রহিয়াছেন সে কথা তখন মনে পড়ে নাই।
ক্রমে শোভনাকে ভুলিতে আরম্ভ করিলাম। তাহার উপর আমার সেই অতি নিষ্ঠুরতার জন্য কখন কখন মন যে অত্যন্ত ব্যাকুল না হইয়াছিল তাহা নহে, কিন্তু সেই আমাকে নিষ্ঠুর করিয়াছিল ভাবিয়া মন স্থির করিতে চেষ্টা করিতাম। প্রাণে এমন একটা দারুণ আঘাত না লাগিলে কেহ কি এমন করিয়া নিজের স্ত্রীর গলায় শাণিত ছুরি বসাইতে পারে?
কয়েক দিবস পরে একদিন অপরাহ্ণে শোভনার সেই বিধবা বাল্যসখী আমার সঙ্গে দেখা করিল। আমাকে শোকার্ত ভাবিয়া কত বকিল, কত বুঝাইল, আমি তাহার সে সকল কথার একটি বর্ণও হৃদয়ঙ্গম করিয়া উঠিতে পারি নাই। কর্ণপাতও করি নাই। সান্ত্বনায় আমার প্রয়োজন? আমি দুঃখিত নহি – শোকার্ত নহি – কাতর নহি।
তাহার পর সে একথা ওকথা অনেক কথার পর আমার হাত ধরইয়া, একটু থতমত খাইযা, জড়িত স্বরে, কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমি জানি, তুমি কখনই কাহারও কাছে প্রকাশ করিবে না। আমার কটি লুকানো কথা এখন তোমার কাছে না বলিলে নয়, তাহাই বলিতে হইতেছে। তুমি হয়তো আমাকে মনে মনে ঘৃণা করিবে। কি করিব? মানুষের মন বশ মানিবার নহে। কতকগুলি গুপ্তপত্র আমি নিজের কাছে রাখিবার কোন সুবিধা না পাইয়া শোভনার নিকট রাখিয়াছিলাম। সে পত্রগুলি যদি তুমি খুঁজিয়া বাহির করিয়া আমাকে দাও – বড় উপকার করিবে।’
তাহার কথা শুনিয়া তখন আমার আপাদমস্তক কাঁপিতে লাগিল। মস্তকে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। মনের গতি ঠিক রাখিতে না পারিয়া তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সে সকল প্রেমপত্রে কি লেখা আছে?’
ক্রোধে বিধবার চক্ষু জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, ‘পত্রে কি লেখা আছে কি না তাহা তোমার জানিবার আবশ্যক কি? ছি ছি রমেশ, তোমার অপেক্ষা তোমার স্ত্রীর হৃদয় শতগুনে মহৎ ছিল। যখন তাহাকে আমি পত্রগুলি রাখিতে দিয়াছিলাম, পত্রে কি লেখা আছে কি না, ভুলিয়াও সে একবার সে কথা জিজ্ঞাসা করে নাই। শোভনা দিব্যি করিয়াছিল সে কখনই আমার গচ্ছিত পত্র পাঠ করিবে না। সে যে আমার পত্রের একটি বর্ণ পাঠ করে নাই এ আমি নিশ্চয় বলিতে পারি। তাহাকে আমি ভাল রকম চিনিতাম, শোভনার ন্যায় অমন সরল স্বভাবের স্ত্রীলোক এ জগতে দুর্লভ।’
আমি। কিরূপে আমি তোমার পত্রগুলি চিনিয়া বাহির করিব?
সে। জরির কাজ করা গোলাপী রঙের ফিতায় পত্রগুলি একসঙ্গে বাঁধা আছে।
আমি। খুঁজিয়া দেখিতেছি।