তখনই আমি রক্ত বন্ধ করিয়া ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিলাম। তিনি যাইবার সময় দুই একবার জোরে জোরে আশ্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘এখন আর আমার কোন কষ্ট হইতেছে না। বেশ সুস্থ হইয়াছি।’
তৃতীয় পরিচ্ছদ
পত্র – প্রথমাংশ
এ কথা আমি সহব্যবসায়ী বন্ধুদিগের দুই-চারিজনকে জানাইলাম। তাঁহারা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন। কি রোগ বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না।
প্রায় মাসাতীতকাল পরে একদিন আমি সেই যুবকের লিখিত একখানি পত্র পাইলাম। পত্রখানি বেশ বড় – অতি ছোট ছোট অক্ষরে ঘেঁষাঘেঁষি লাইনে লেখা। নিম্নে নিজের যে নাম লিখিয়াছেন তাহা যদি তাঁহার স্বাক্ষর হয়, বুঝিলাম, তাহা হইলে তাঁহার হস্তে আর সেরূপ যন্ত্রণা নাই। নতুবা লেখনী ধারণ করা তাঁহার পক্ষে দুঃসাধ্য হইত।
পত্রখানি এইরূপ: –
ডাক্তার মহাশয়!
এতদিনে বুঝিতে পারিয়াছি আপনি কিংবা চিকিৎসা-শাস্ত্রে এমন কোন বিধান নাই, যাহা আমার এ যন্ত্রণার কারণ নিরূপণ করিতে পারে। উঃ! এ যন্ত্রণা কি প্রাণান্তকর!
আজ আমি আপনার নিকট আমার এ যন্ত্রণার মূল কারণ প্রকাশ করিব। গত সপ্তাহে আবার আমার হাতে ঠিক সেই স্থানে সেইরূপ দারুণ যন্ত্রণা আরম্ভ হয়। সে যন্ত্রণা সহ্য করা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিল। আপনাকে একদণ্ড পত্র লিখিব মনে মনে স্থির করিলাম, কিন্তু লেখনী চালনা করিবার ক্ষমতা আমার নাই। ভাবিয়া চিন্তিয়া এক উপায় স্থির করিলাম,, সেই যন্ত্রণাময় ক্ষতস্থানে আম আমি জ্বলন্ত অঙ্গার স্থাপন করিলাম। আপনারা যেরূপ poultice বাঁধেন, সেইরূপে লোহার তার দিয়া সেই জ্বলন্ত অঙ্গারখণ্ড সেই ক্ষতস্থানে চাপিয়া বাঁধিলাম। যতক্ষণ সেই অগ্নি নিভে নাই ততক্ষণ আমি কোন যন্ত্রণা অনুভব করি নাই। তুলনায় সে যন্ত্রণার কাছে, অগ্নিদাহের যন্ত্রণা কিছুই নহে। এরূপ না করিলে কখনই আমি একটি কথাও আপনাকে আজ লিখিয়া জানাইতে পারিতাম না। ছয় মাস পূর্বের কথা বলিতেছি; তখন আমার সুখের সীমা ছিল না। আমার মাসিক যে আয় ছিল তাহাতে আমার বেশ সুখ স্বচ্ছন্দে দিনাতিবাহিত হইত।
দুই বৎসর পূর্বে আমি আমাদিগের কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর একটি সুন্দরী, সুশীলা, কন্যাকে বিবাহ করি; তাহার স্বভাব চরিত্রের কথা ঠিক বর্ণনা করিতে পারিলে উপন্যাসের গাথা স্বরূপ হইয়া পড়ে। তাঁহার নাম শোভনা। আমাকে একদণ্ড ছাড়িয়া সে থাকিতে পারিত না। একদণ্ড যদি আমাকে আমি তাহার চক্ষুর অন্তরালে রাখিতাম, তাহার সেই মুখমণ্ডল মলিন হইয়া যাইত। নয়ন সজল হইত, সাত পাঁচ ভাবিয়া কেমন এক রকম হইয়া পড়িত। যদি কোনদিন বাটি ফিরিতে অনেক রাত হইত, হতভাগিনী আমার জন্য, এই পিশাচের জন্য জাগিয়া বসিয়া থাকিত – ঘুমাইত না – আমার অপেক্ষায় বসিয়া কাঁদিত। এখন বেশ বুঝিতেছি তাহার সেই অগাধ ভালবাসা এ পৃথিবীর ছিল না।
এমন কি আমাকে ছাড়িয়া শোভনা পিতৃগৃহেও যাইতে চাইত না। আমি বরং বিশেষ করিয়া, বলিয়া কহিয়া মধ্যে মধ্যে দেখাশুনা করিয়া আসিতে বলিতাম। কথা ঠেলিতে পারিত না, যাইত; কিন্তু এক বেলার অধিক থাকিতেও পরিত না।
আপনি বলিবেন, কোন স্ত্রী তাহার স্বামীকে যতদূর ভালবাসিতে হয় বাসে না? আমিও তাহা স্বীকার করিয়া লইতেছি; কিন্তু, কোন স্বামী এমন ভালবাসা পাইয়া সুখী হয় না। তেমন প্রগাঢ় ভালবাসা কোন স্বামীর সহ্য হয় না, তাই সেটুকু সে সাধ করিয়া নিজে নষ্ট করে? আমি, আমি, আমি সেই নরাধম স্বামী। আমিই সেই নরপ্রেত। – হায়, হায়~ অমরাবতীতে নন্দন-কাননের পারিজাততলে, রত্নবেদীতে বসিয়া সাধ্বী-সতী ইন্দ্রাণী শচীর স্বহস্তে গাঁথা পারিজাত মালা নির্মাল্য স্বরূপ কি জানি কোন ভ্রমক্রমে বুঝি এ নরপিশাচের গলায় আসিয়া পড়িয়াছিল। সে অপার্থিব স্বর্গীয় সামগ্রীর আদর আমি কি বুঝিব, তাই অতি শীঘ্র দিব্য গন্ধ পারিজাত সম্ভার শতখণ্ডে ছিঁড়িয়াছি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পত্র মধ্যাংশ
মানুষ কি পাগল! সেই জন্য বুঝি অতি সুখের ভিতর হইতে কোথায় দুঃখ আছে সাধ করিয়া আপনা হইতে তাহাই আগে টানিয়া বাহির করিতে চায়! কি জানি একদিন কোন শয়তানের কি মোহমন্ত্র কুক্ষণে আমার কর্ণে পশিল।
আমার স্ত্রীর আলাহিদা একটি বাক্স ছিল, কখন সে সেই বাক্সের চাবি দিতে ভুলিত না, কি সেই চাবি কখন ভুলিয়া ফেলিয়া রাখিত না; এই দুই বিষয়ে সে সদা সাবধান থাকিত। এত সতর্কতার কারণ কি?
এত সতর্কতার কারণ কি? ইহাই আমার হৃদয়ের মধ্যে সর্বদা তখন আন্দোলিত হইতে লাগিল। এই এক চিন্তায় আমায় যতদূর অস্থির করিয়া তুলিতে হয় তুলিল। আমি পাগলের মত হইয়া পড়িলাম।
মনের ভিতর দারুণ সংশয়, দারুণ দুর্ভাবনা, দারুণ অবিশ্বাস। তাহার সেই অপার্থিব ভালবাসা, সেই অসীম অনুরাগ, সেই স্বর্গীয় পবিত্রতা কিছুরই উপর আর বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। সকলই যেন ভণ্ডামি বলিয়া বোধ হইতে লাগিল।
সেই সরলতা মাখা দৃষ্টি, সেই মুখমণ্ডলের অকলঙ্ক ভাব, আবেশময় প্রেমালিঙ্গন, সে সকলে যেন কে বিষ মাখাইয়া কি এক বিষের আগুন জ্বালাইয়া দিল।
একদিন শোভনার একটি বাল্যসখী আসিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া তাহাকে নিজের বাটিতে লইয়া যাইবার জন্য বড় জেদাজেদি আরম্ভ করিল। এখনও তাহাদের মধ্যে পরস্পরের বড় ভালবাসা ছিল। কিন্তু শোভনা আমাকে ছাড়িয়া তাহার সহিত কিছুতেই যাইতে চাহে না। তখন শোভনার সেই বাল্যসখী আমাকে আসিয়া ধরিয়া বসিল; আমি শোভনাকে তাহার সঙ্গে যাইতে বলিলাম। শোভনা আমার কথা কখন ঠেলিত না – যাইতে চাহিল। শোভনার বাল্যসখী – বাল্যবিধবা।
সেই দিন যাইবার সময় শোভনা যথায় চাবি লুকাইয়া রাখিল আমি দূরে থাকিয়া গোপনে দেখিলাম। সে চলিয়া গেলে আমি সেই চাবি বাহির করিলাম। তাড়াতাড়ি সেই বাক্স খুলিয়া ফেলিলাম, আমার অন্তরাত্মা কাঁপিতে লাগিল। হাত হইতে চাবি ভূতলে পড়িয়া গেল। হৃদয় দৃঢ় করিযা আমি সকল জিনিস উল্টাইয়া পাল্টাইয়া তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে লাগিলাম। পাছে সে আসিয়া বুঝিতে পারে তাহার অসাক্ষাতে আমি তাহার বাক্স খুলিয়াছিলাম সেইজন্য আবার যথাকার যে সামগ্রী পূর্ববৎ সাজাইয়া রাখিতে লাগিলাম।
এটা ওটা তুলিতে রাখিতে দেখিতে পাইলাম, বাক্সের এক কোণে একতাড়া পত্র রহিয়াছে; তাড়াতাড়ি টানিয়া বাহির করিলাম। বুকের ভিতর তুমুল ঝটিকা বহিতে লাগিল। নিশ্বাস রুদ্ধ হইয়া গেল, রুদ্ধশ্বাসে, কম্পিত করে, সশঙ্ক হ্রদয়ে পত্রগুলি পড়িতে গেলাম; তখন বুকের ভিতর যেন বিদ্যুদগ্নি ঝকিয়া ঝকিয়া মস্তকে প্রবেশ করিল। কি ভয়ানক! এ সকল যে প্রেমপত্র।
পত্রগুলি জরির কাজ করা গোলাপী রঙের একটুকরা ফিতায় বাঁধা ছিল – খুলিলাম। পড়িতে যাই – পারি না, সাহসে কুলায় না। কোথা হইতে কোন পিশাচ যেন তখন হাঁকিয়া হাঁকিয়া আমার কানে কানে বলিয়া দিল, ‘ভীরু। পড়িয়া দেখ – সকলই বুঝিতে পারিবে।’
কেহ তথায় ছিল না; এমন কি ভিত্তি গাত্রে এমন একখানি দর্পণও ছিল না – যাহাতে আমারই নিজের মূর্তি প্রতিবিম্বিত হইয়া সে সময়ে আমাকে একবারের জন্যও লজ্জিত করে – ধিক্কার দেয়। একে একে সকল পত্রই আমি পড়িলাম। প্রত্যেকখানিরই নিম্নে আমার একজন বন্ধুর নাম স্বাক্ষর দেখিলাম। পত্রগুলি সাবধানে রাখিবার জন্য প্রত্যেক পত্রেই যথেষ্ট করিয়া সাবধান করা হইয়াছে।
তখন আমার মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল, কে জানিবে? সর্বাঙ্গে বিষদাহের যন্ত্রণা হইতে লাগিল। পাঠশেষে পত্রগুলি তেমনি করিয়া আবার বাঁধিয়া ফেলিলাম; যে স্থানে ছিল তেমনি করিয়া আবার রাখিয়া দিলাম। কম্পিত হস্তে বাক্স রুদ্ধ করিলাম।