পকেট হইতে তিনি একখানি শাণিত ছুরিকা বাহির করিলেন। আমি অবাক হইয়া তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। পর মুহূর্তে দক্ষিণ হাতের নির্দিষ্ট স্থানে তিনি সেই ছুরি বিদ্ধ করিলেন; অজস্র ধারে রক্ত বাহির হইল। সেই একগুঁয়ে যুবককে আমি বলিলাম, ‘যদি একান্তই কাটিতে হইবে – আমি কাটিযা দিতেছি।’
বাঁ হাতে তাঁহার দক্ষিণ হাত ধরিয়া, তাঁহার হাত হইতে ছুরিখানি লইয়া বলিলাম, ‘মুখ ফিরিয়া দাঁড়ান, রক্ত দেখিয়া অনেকে জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে।’
তিনি বলিলেন, ‘কোন আবশ্যক নাই, আমি তো আপন ইচ্ছায় আপনাকে অস্ত্র করিবার নিমিত্ত পীড়াপীড়ি করিতেছি।’
আমি তাঁহার কথামত সেই নির্দিষ্ট অংশের মাংসখণ্ড কাটিয়া তুলিলাম। প্রবল বেগে রক্তস্রোত বহিতে লাগিল। স্থিরদৃষ্টে তিনি সকলই দেখিতেছিলেন। কাটিবার সময় মুখে যন্ত্রণার কোন চিহ্ন দেখা যায় নাই – হাত কাঁপে নাই – নড়ে নাই। যখন মাংসখণ্ড কাটিয়া পৃথক করা হইল, তখন তাঁহার বদনবিবর ও নাসারন্ধ্র দিয়া একটি অতি তৃপ্তির দীর্ঘ নিশ্বাস সশব্দে বহিল। সেই সঙ্গে বলিলেন, ‘আঃ বাঁচিলাম।’
‘এখন আর কোন যন্ত্রণা নাই?’
‘না – কিছু না – সকল যন্ত্রণা গিয়াছে। ঐ মাংসখণ্ডের সঙ্গেই সকল যন্ত্রণা উবিয়া গিয়াছে। আঃ বাঁচিলাম, আর এই রক্তপাত কিছুই নহে, আর একদিনের কথা মনে হইলে ইহা তার কাছে অতি সামান্য। যত রক্ত বাহির হইতেছে ততই যেন আমার শরীর সুস্থ হইতেছে; যত বাহির হইতে পারে হোক, লাভ বই ক্ষতি নাই?’
যতক্ষণ রক্ত ছুটিতে লাগিল, ততক্ষণ যুবক আনন্দোৎফুল্ল নয়নে তাহা দেখিতে লাগিলেন। যত শীঘ্র পারিলাম আমি ঔষধাদির দ্বারায় রক্ত বন্ধ করিয়া, ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিলাম।
ইতিমধ্যে তাঁহার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখভাব সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইল। যেন তিনি নূতন জীবন পাইলেন। তাঁহার সেই অতি ম্লান নয়নদ্বয় আনন্দোদ্ভাসিত হইয়াছে। ললাটদেশ আর কুঞ্চিত নহে; যেন তিনি আর তিনি নহেন।
যুবক বলিলেন, ‘মহাশয়, আপনাকে শত শত ধন্যবাদ। আপনার কৃপায় আমি সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিয়াছি। যৎকিঞ্চিত আপনাকে পারিশ্রমিক স্বরূপ দিলাম; কিন্তু আপনি আজ আমার যে উপকার করিলেন তাহার কাছে উহা কিছুই নহে। আপনার ঋণ অপরিশোধ্য; চিরজীবন আপনার নিকট কৃতজ্ঞ রহিলাম।’
আমি তাঁহার প্রদত্ত একশত টাকার নোট গ্রহণ করিতে অস্বীকার করিলাম। তিনিও কোনমতে তাহা ফিরাইয়া লইতে চাহেন না। শেষে অমাকে তাঁহার সেই পীড়াপীড়িতে বিরক্ত হইতে দেখিয়া বলিলেন, ‘আপনি যদি একান্তই না গ্রহণ করেন, কোন দাতব্য চিকিৎসালয়ে দান করিযা বাধিত করিবেন।’ বলিয়া চলিয়া গেলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ডাক্তারবাবুর কথা – ক্রমশ
এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল, আর সেই অপরিচিত রোগীটির দেখা পাইলাম না। দ্বিতীয় সপ্তাহ অতিবাহিত হইল তথাপি সংবাদ নাই। দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষে একদিন প্রাতঃকালে আমি আপনার শয়ন-প্রকোষ্ঠে বসিয়া একখানি সংবাদপত্র পাঠ করিতেছি, এমন সময় দ্বারবান আসিয়া সংবাদ দিল, আবার নাকি সেই রোগশূন্য রোগী, উন্মত্তপ্রায় যুবক আসিয়াছেন।
তাঁহার কাণ্ডকারখানায় আমার মনে অতিশয় কৌতূহল হইয়াছিল; তখনই বহির্বাটিতে গিয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। প্রথমবার যেমনভাবে তাঁহাকে দেখিয়াছিলাম, এবারও তাহাই দেখিলাম। সেইরূপে সেই দক্ষিণ হস্ত সেই রেশমী রোমালে গলদেশে বাঁধা রহিয়াছে। সেইরূপ মুখমণ্ডল মলিন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট, ম্লান। ললাট কুঞ্চিত, চক্ষু কালিমালেপিত নিষ্প্রভ; তাহার সেইরূপ ভাব দেখিয়া স্তম্ভিত হৃদয়ে আমি জিজ্ঞাসিলাম, ‘আবার কি হইয়াছে?’
যুবক উত্তর করিলেন, ‘ঠিক কাটা হয় নাই।’ স্বর অতি ক্ষীণ – অতি মৃদু, আগেকার চেয়ে এখন যাতনা আরও বাড়িয়াছে, কিছুতেই আর সহ্য হইতেছে না। ইচ্ছা ছিল আর আপনাকে কষ্ট দিব না; মনে করিয়াছিলাম এই যন্ত্রণা হয়তো মাথায় কিংবা বুকে উঠিবে, তাহা হইলে যন্ত্রণাময় জীবনের সঙ্গে এ যন্ত্রণা ঘুচিয়া যাইবে। কই, তাহা হইল না, যেখানকার যন্ত্রণা ঠিক সেইখানে আছে, এক তিল নড়ে নাই। আমার মুখের দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখুন, তাহা হইলেই ঠিক বুঝিতে পারিবেন, আমার কত যন্ত্রণা হইতেছে।’
যুবকের বর্ণ গৌর হইলেও কে যেন সত্য সত্যই তাহার সর্বাঙ্গে কালি মাড়িয়া দিয়াছে। ললাট ঘর্মবিন্দুতে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। যন্ত্রণায় মধ্যে মধ্যে তাহার শ্বাস রুদ্ধ হইযা যাইতেছে। ক্ষতস্থানের বাঁধন অতি সন্তর্পণে খুলিয়া ফেলিলাম। দেখিলাম ক্ষতস্থান নূতন মাংসে প্রায় পূর্ণ হইয়া আসিয়াছে; আশ্চর্যের কিছুই দেখিলাম না। হাত টিপিয়া নাড়ী দেখিলাম, অতি দ্রুত কিন্তু জ্বরের তো কোন প্রমাণই নাই।
আমি বিস্মিত হইয়া বলিলাম, ‘এমন আশ্চর্য ব্যাপার আমি কখন দেখি নাই।’
‘বড়ই আশ্চর্য কাণ্ড – বড় ভয়ানক; যাহাতে আমি এ দারুণ যন্ত্রণা হইতে শীঘ্র নিষ্কৃতি পাই তাহাই করুন, কি হইয়াছে কি না হইয়াছে দেখিবার কোন আবশ্যক নাই। এ ভীষণ যন্ত্রণা হইতে আমাকে নিস্তার করুন। এবারে বেশি গভীর করিয়া কাটিয়া দিন; বোধহয় তাহা হইলেই আমি সুস্থ হইতে পারিব।’
আমি এবার তাঁহার কথামত পূর্বাপেক্ষা গভীর করিয়া সেই স্থানে কাটিয়া দিলাম। মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তখন তাঁহার সে বিবর্ণীকৃত মুখমণ্ডলে আর কোন যন্ত্রণাব্যঞ্জন চিহ্ন নাই। ক্ষতস্থান দিয়া প্রবল বেগে রক্ত ছুটিতেছে; স্থির, সফুল্লনেত্রে তিনি তাহাই দেখিতেছেন।