- বইয়ের নামঃ সতী শোভনা
- লেখকের নামঃ পাঁচকড়ি দে
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
সতী শোভনা
প্রথম পরিচ্ছেদ
ডাক্তারবাবুর কথা
বেলা দ্বিপ্রহর। আহারাদি শেষে একটু বিশ্রাম করিব মনে করিতেছিলাম বটে, কিন্তু কার্যত ঘটিয়া উঠিল না। বাহির হইতে সংবাদ আসিল, কে একটি ভদ্রলোক বহির্বাটিতে আমার জন্য অপেক্ষা করিতেছেন – বিশেষ আবশ্যক, এখনই দেখা করিতে হইবে।
আমি বাহিরে আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। আগন্তুকের বয়ঃক্রম সপ্তবিংশতি বৎসর; বর্ণ গৌর। মুখমণ্ডল সুন্দর হইলেও এক্ষণে যন্ত্রণাবিবর্ণীকৃত। গঠন ঈষদ্দীর্ঘ। একখানি রেশমী রুমালে দক্ষিণ হস্ত বক্ষের উপর ঝুলাইয়া গলদেশে বাঁধা। আমাকে দেখিয়াই, দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া সেই যুবক ক্ষীণতর স্বরে বলিলেন, ‘মহাশয়ের নাম কি কালীকৃষ্ণবাবু?’
‘হাঁ, আমারই নাম।’
‘ক্ষমা করিবেন, আমি কখন আপনাকে দেখি নাই। লোকের মুখের আপনার অনেক সুখ্যাতি শুনিয়াছি।’
দেখিলাম, তিনি তখন দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছেন; পদদ্বয় যেন তাঁহার দেহভার আর বহন করিতে পারিতেছে না; যন্ত্রণায় প্রাণ বাহির হইয়া যাইতেছে। প্রথম একটু একটু যন্ত্রণা কখন হইত; কখন হইত না; কিন্তু এখন বড় ভয়ানক দাঁড়িয়েছে – এক মুহূর্তের জন্য আমি স্থির হইতে পারিতেছি না। দিন দিন যাতনা বাড়িয়া উঠিতেছে; আর আমি সহ্য করিতে পারি না; কে যেন একখণ্ড জ্বলন্ত অঙ্গার হাতের উপর চাপিয়া ধরিয়াছে – এমনই যন্ত্রণা। আপনি যদি অনুগ্রহ করিয়া কাটিয়া দেন, বড়ই উপকৃত হই; এমন কি আর এক ঘণ্টা যদি এই যন্ত্রণা আমাকে ভোগ করিতে হয় – আমি পাগল হইয়া যাইব।’
আমি তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলাম, প্রথমে অস্ত্র করিবার কোন আবশ্যক নাই, প্রলেপাদির দ্বারা যাহাতে তাঁহার যন্ত্রণা দূর হয় করিব।
যুবক এবার একটু জোরে জোরে বলিলেন, ‘না, না ডাক্তারবাবু, প্রলেপ-প্রয়োগে ইহার কিছু হইবে না; আপনি অস্ত্র করিয়া দিন, নতুবা এ যন্ত্রণ যাইবে না; যেখানে যন্ত্রণা হইতেছে সেখানকার মাংস কাটিয়া তুলিয়া ফেলুন।’
হাতের কোনখানে তেমন যন্ত্রণা হইতেছে আমি দেখিতে চাহিলাম। ধীরে ধীরে তিনি রুমাল হইতে হাত বাহিরে করিলেন; বাহির করিয়া ধীরে ধীরে আমার টেবিলের উপর অতি সন্তর্পণে রাখিলেন। বলিলেন, ‘ডাক্তার মহাশয়, আপনি পরীক্ষা করিয়া যাহাই বুঝুন, আপনি কাটিয়া দিন। আমাকে কতদূর যাতনা ভোগ করিতে হইতেছে কথায় আপনাকে কি করিয়া বুঝাইব?’
আমি তাঁহার হাতখানি ধীরে ধীরে তুলিলাম। যন্ত্রাদির সাহায্যে বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। কোন রোগের কোন প্রমাণই পাইলাম না। তাঁহার হাতে আর আমার হাতে কোন পার্থক্য নাই – নীরোগ। আর তত গ্রাহ্য না করিয়া আমি তাঁহার হাত ছাড়িয়া দিলাম, সশব্দে তাঁহার সেই হাতখানি টেবিলের উপর পড়িয়া গেল।
যুবক উৎকট যন্ত্রণায় বিকট চিৎকার করিয়া তখন কাঁদিয়া উঠিলেন। বাম হাত ধীরে ধীরে ডান হাত তুলিলেন। তাঁহার ভাবে বোধ হইল, তিনি বস্তুতই অতিশয় যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন।
আমি বলিলাম, ‘ঠিক কোন স্থানে যন্ত্রণা হইতেছে আমাকে দেখাইয়া দিন।’
‘এইখানে।’ বলিয়া তিনি অঙ্গুলি নির্দেশ করতলের উপরিভাগে – যেখানে দুইটি স্থূল শিরা একত্রে মিশিয়াছে – দেখাইলেন। আমি ধীরে ধীরে সেই স্থান টিপিয়া দেখিতে লাগিলাম, ইহাতে তখন তাঁহার সর্বাঙ্গ কম্পিত হইতেছিল।
আমি বলিলাম, ‘ইহাতেও কি আপনার যন্ত্রণা হইতেছে?’
তিনি কোন উত্তর করিলেন না। দেখিলাম, তাঁহার চক্ষু দুটি অশ্রুজলে ভরিয়া গিয়াছে। ভাবিয়া পাইলাম না কি এমন যন্ত্রণা!
আমি। কি আশ্চর্য! আমি তো কিছুই দেখিতে পাইতেছি না।
তিনি। তবে এ যন্ত্রণা কেন হইতেছে? ইচ্ছা হইতেছে দেয়ালে ঠুকিয়া নিজের মাথা নিজে ভঙ্গিয়া ফেলি – মরিয়া যাই – যন্ত্রণার অবসান হোক।
আমি magnifying glass দিয়া বিশেষ করিয়া তন্নির্দিষ্ট স্থান পরীক্ষা করিলাম, কিছুই নয়। বলিলাম, ‘কই, কিছুই দেখিতেছি না। আপনার হাতের অন্যান্য স্থান যেমন এটুকুও তেমনি।’
‘আমার বোধ হইতেছে ওখানটা লাল হইয়াছে।’
‘কই?’ যুবক তখন পকেট হইতে একটা wooden pencil বাহির করিয়া ধীরে ধীরে অস্পষ্ট রেখায় হাতের সেইখানে একটি আধুলির মতন গোল করিয়া ক্ষুদ্র চিহ্ন করিলেন।
আমি তাঁহার দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলাম। ভাবিলাম, বোধ হয় একটু না একটু পাগলের ছিট আছে। বলিলাম, ‘আপনি কিছুদিন এখানে অপেক্ষা করুন, আরোগ্য লাভ করিতে পারিবেন।’
যুবক। থাকিতে পারিব না। এমন মনে করিবেন না যে আমি পাগল। এখানে থাকিলে আপনি এমন কি উপায় স্থির করিয়াছেন যে আমি নিশ্চয় নীরোগ হইব? আর কোন উপায় নাই। যেটুকু আমি পেন্সিল দিয়া দাগ করিয়াছি, আপনি কাটিয়া ফেলুন – এ উৎকট যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি পাই।
আমি। আমি পারিব না।
যুবক। কেন?
আমি। অস্ত্র করিবার কিছুই দেখিতেছি না। আপনি যে স্থান দাগ কাটিয়া দেখাইতেছেন ঠিক আমার হাতের ন্যায় – রোগের তো কিছুই দেখিতেছি না।
যুবক।। আপনি কি মনে করিতেছেন আমি পাগল না আপনার সহিত বিদ্রূপ করিতে আসিয়াছি। এই নিন, আপনার পারিশ্রমিক নিন, ‘ঐটুকু বেশ করিয়া কাটিয়া দিন; আমি আপনার সহিত ছেলেমানুষী করিতে আসি নাই।’
পকেট হইতে তিনি একখানি একশত টাকার নোট বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিলেন।
আমি। আমি এখনও বলিতেছি, আমি পারিব না।
যুবক।। কেন পারিবেন না?
আমি। না, ইহা আমার দ্বারা হইবে না। আমার এ কার্যে আমাকে সাধারণের নিকট নিন্দাভোগ করিতে হইবে। সকলেই আপনাকে শুধু পাগল ভাবিবে না, আমাকেও বদ্ধ পাগল বলিয়া জানিবে।
যুবক। বেশ, না পারেন, আর একটি আমার সামান্য কথা রাখুন, আমি আপনা আপনি ঐটুকু কাটিয়া ফেলিতেছি। বাঁ হাতে যদিও সুবিধা মত কাটিতে পারিব না, তাহাতে ক্ষতি নাই। তাই হোক, আপনি ঔষধাদি দিয়া বাঁধিতে দিবেন।