আগন্তুককে নিয়ে সামন্তমশাই তার দোকানের প্রাইভেট রুমের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন। আধঘণ্টা পরে ভদ্রলোক বের হয়ে গেলেন। কর্মচারীদের মধ্যে জনা-দুই ও দারোয়ান তখন প্রভুর ঘর থেকে বেরোবার অপেক্ষায় বসে, কিন্তু সামন্তমশাই আর ঘর থেকে বেরোন না। এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা, দু ঘণ্টা কেটে গেল, তখন একজন কর্মচারী অধৈর্য হয়েই গিয়ে দরজার সামনে এসে ডাক দিল।
কোন সাড়া পাওয়া গেল না সামন্তর তাই না?
হ্যাঁ, দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে কর্মচারীটি চিৎকার করে উঠল। চেয়ারের ওপর উপবিষ্ট সামন্তমশাই, গলায় নীল রুমালের ফাঁস, মুখটা সামান্য হাঁ হয়ে আছে, চোখের মণি দুটো যেন কোঠর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসছে।
হুঁ। আচ্ছা সেই আগন্তুকের চেহারার কোন বর্ণনা পেয়েছ?
পেয়েছি। রোগা পাকানো চেহারা, চোখে কালো কাচের একটা চশমা, পরনে দামী স্যুট।
কিরীটী যেন চিন্তিত। কি যেন ভাবছে মনে হল।
বিকাশ বলতে লাগল, এবারেও কোন কিছু চুরি যায়নি।
স্বাভাবিক। কিরীটী মৃদু গলায় বললে, কারণ হত্যার জন্যই যেখানে হত্যা, সেখানে তো অন্য কিছুর নিদর্শন থাকতে পারে না। ভাল কথা, সামন্তমশাই বিবাহিত ছিলেন?
হ্যাঁ। স্ত্রী ও দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর বছরখানেক আগেই খুব ধুমধাম করে। ছেলেদের একজনের বয়স বারো, আরেকজনের আট বছর। কিছুদিন আগে বালিগঞ্জ অঞ্চলে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করতেও শুরু করেছিলেন।
আচ্ছা বিকাশ—
বলুন।
সেই রুমাল দুটো দেখেছ?
হ্যাঁ। একজিবিট হিসেবে লালবাজারেই আছে। দেখে এলাম। অবিকল সেই একই ধরনের আকাশ-নীল রঙের রেশমী রুমাল এবং তাদের একটির কোনায় ইংরাজী সাঙ্কেতিক অক্ষর 1 ও অন্যটিতে 2 লেখা।
কিরীটী বললে, যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তিনটি হত্যার পেছনে একই ব্যক্তির অদৃশ্য হাত রয়েছে, সে সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইল না।
আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। বিকাশ সেন বললে।
আরও একটা ব্যাপার হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে নিশ্চয়ই তোমার নজরে পড়েছে বিকাশ–
কি বলুন তো?
প্রথম ব্যক্তি শ্ৰীমন্ত পোদ্দারের মৃত্যুর কুড়ি দিন পরেই নিহত হলেন হারাধন সামন্ত, এবং তার ঠিক দিন-কুড়ি পরে তৃতীয় ব্যক্তি নীল রুমালের ফঁসে প্রাণ দিলেন আমাদের শশধর সরকার।
হিসেব তো তাই দাঁড়াচ্ছে।
এবং দুবার এক আগন্তুকের আবির্ভাব এবং তৃতীয় কিস্তিতে সামান্য অদল-বদল-a telephone call from some unknown person! হয়ত শশধরেরও দোকানে। প্রবেশ করে সেই রোগা লম্বা পাকানো চেহারার আগন্তুকের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল। তাহলেই ভেবে দেখ, মোটামুটি হত্যাকারীর একটা চেহারার বর্ণনা যেমন আমরা পাচ্ছি, তেমনি এও বোঝা যাচ্ছে, হত্যাকারী একজন—একাধিক ব্যক্তি না। খুব planned wayতে সে হত্যা করে চলছে একের পর এক।
আপনার কথায় তাই তো মনে হচ্ছে মিস্টার রায়!
তোমাকে এখন বাকি কাজটি করতে হবে সেন—
কোন কাজটা বলুন তো?
বছর পাঁচেক আগে কি সব আভ্যন্তরিক কারণে তুমি বলছিলে না, সরকার অ্যান্ড, সন্স বিখ্যাত জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়
হ্যাঁ।
কেন বন্ধ হয়েছিল,-কারণটা কি, এবং সেই পরিবারের সকলে এখন কে কোথায়। আছে, কে কি করে, তাদের প্রত্যেকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটা খোঁজখবর নিতে বলছিলাম না—নিয়েছ?
না! কিন্তু আপনার কি মনে হয় মিস্টার রায়—
কি?
সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারের সঙ্গে বর্তমান হত্যা-রহস্যগুলোর কোন যোগাযোগ আছে বলে আপনার মনে হয়?
হয়ত নেই, আবার হয়ত থাকতেও পারে।
তাছাড়া ব্যাপারটা তো অনেক দিন আগেকার
হ্যাঁ, পাঁচ বছর আগেকার ব্যাপার। কি জান বিকাশ, হত্যার বীজ যে এক-এক সময় কখন কোথায় কীভাবে রোপিত হয় বা অঙ্কুরিত হতে থাকে, কেউ তা বলতে পারে না। বিশেষ করে এই ধরনের হত্যার ব্যাপার। তাই ব্যাপরটা সম্পর্কে আমি জানতে চাই।
বেশ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবাদগুলো আমি আপনাকে জানাবার চেষ্টা করব। সে আর এমন কঠিনই বা কি!
আজ তাহলে আমি উঠি, বুঝলে?
চা খাবেন না?
না।
কিরীটী উঠে পড়ল।
.
থানা থেকে বের হয়ে কিরীটী সোজা গেল তার গাড়িতে করে ডালহৌসি স্কোয়ারে প্রত্যহ নামক দৈনিক সংবাদপত্রের নতুন হেড অফিসে।
সেখানকার একজন নিউজ-এডিটর সঞ্জীব লাহিড়ীর সঙ্গে কিরীটীর বিশেষ পরিচয় ছিল। অল্প বয়স খুব চালাক-চতুর এবং চটপটে ছোকরা।
সঞ্জীব তার অফিস-কামরায় ছিল না। মিনিট পনেরোর মধ্যেই হয়ত সে ফিরবে। একজন বলায় কিরীটী তার ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে।
বিশ মিনিট পরে সঞ্জীব ফিরে এল।
কিরীটীকে দেখে সে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে, দাদা যে! কি খবর?
একটা খবর চাই।
কি খবর?
কিরীটী তখন ‘প্রত্যহে’ প্রকাশিত বিচিত্র বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করে বললে, একটু খোঁজ নিয়ে বলতে পার সঞ্জীব, ওই বিজ্ঞাপনটা কতদিন থেকে প্রকাশ হচ্ছে এবং কে দিয়েছে?
বসুন, আমি দেখছি।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই সঞ্জীব যা সংবাদ সংগ্রহ করে নিয়ে এল তা হচ্ছে-বিজ্ঞাপনটি গত দুমাস ধরে প্রকাশিত হচ্ছে। দিল্লী থেকে নতুন এক পাবলিশার্স কনসার্ন বিজ্ঞাপনটি দিচ্ছে। বেদপাল পাবলিশিং কোম্পানি। দরিয়াগঞ্জে তার অফিস।
ঠিকানাটা টুকে নিয়ে কিরীটী উঠে পড়ল।
.
পরের দিন সকালের প্লেনেই কিরীটী দিল্লী চলে গেল।