ব্যক্তিগত কোন আক্রোশ কি?
কিন্তু কীসের আক্রোশ? কি ধরনের আক্রোশ?
ঝনঝন করে পাশে টেলিফোনটা টেবিলের উপরে বেজে উঠল। আঃ, শালারা একটু নিশ্চিন্তে বসে বিশ্রামও করত দেবে না। ঘণ্টাচারেক হন্তদন্ত হয়ে রোদে ছোটাছুটি করে এসে একটু বসেছি-একান্ত বিরক্ত ভাবেই ফোনটা তুলে নিল : ও- সি. বৌবাজার স্পিকিং!
ও প্রান্ত থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে, বিকাশ—আমি কিরীটী।
সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ সেনের মুখের ওপর থেকে বিরক্তির মেঘটা যেন কেটে যায়। সে উগ্রীব হয়ে ওঠে, সোজা হয়ে বসে।
বলুন, বলুন রায় সাহেব—
তুমি এখান থেকে যাবার পর সকালে একবার ফোন করেছিলাম।
আমি এই ফিরছি। কি ব্যাপার বলুন তো? ফোন করেছিলেন কেন?
সকালে তখন কয়েকটা কথা তোমাকে বলতে পারিনি—
কি কথা?
এর আগে যে দুজন জুয়েলার এ শহরে নীল রুমালের ফঁসে নিহত হয়েছে, তারা কোথায় কি ভাবে কখন নিহত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে ডিটেলস্ খবরাখবর একটা যোগাড় করতে পার?
কিছুটা সংগ্রহ করেছি রায় সাহেব—
করেছ? খুব ভাল সংবাদ–
হ্যাঁ। আর সেই খবরের জন্যই এতক্ষণ বাইরে ঘুরে এলাম।
কি জানতে পারলে বল? টেলিফোনেই বলব, না
না, শোন, আমি আগামী কাল সকালেই দিন-কয়েকের জন্য দিল্লী যাচ্ছি প্লেনে—
হঠাৎ দিল্লী?
ওখানে এক মন্ত্রী মশাইয়ের দপ্তর থেকে একটা গোপন কনফিডেনসিয়াল দলিল বেপাত্তা হয়ে গেছে, তাই মন্ত্রী মশাই কিছুক্ষণ আগে এক জরুরী ট্রাঙ্ককল করেছিলেন আমায়–
তাহলে?
কি তাহলে?
এদিককার কি হবে?
কীসের—তোমার নীল রুমাল রহস্যের?
হ্যাঁ।
ভয় নেই, আমার ধারণা বা অনুমান যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে আমাদের নীল রুমালের ভদ্রলোকটি এখুনি আবার তার হাত প্রসারিত করবেন না, কিছুটা অন্তত সময় নেবেন।
কিন্তু যদি না নেয়—
নেবে। অন্তত দিন পনেরো-কুড়ি তো নেবেই—সাধারণ যুক্তিতে। কারণ—
কি?
পুলিসকে যে তৃতীয়বার বোকা বানাল, সেই আত্মশ্লাঘা বা আত্মতৃপ্তিটা অন্তত কিছুদিন তো একটু যাকে বলে চেখে চেখে উপভোগ করবেই, মনে মনে হাসবে। ভয় নেই ভায়া, তার ওই আত্ম-অহমিকাই তার রথচক্র গ্রাস করবে ঠিক সময়ে। গতি রুদ্ধ হবে।
বলছেন!
হ্যাঁ, বলছি। যাক, যা বলছিলাম, ওই খবরগুলো কীভাবে সংগ্রহ করলে?
ফোনেই বলি–
না, থাক। বরং তুমি এখন আছ তো?
হ্যাঁ।
আমিই কিছুক্ষণের মধ্যে যাচ্ছি। সংবাদটা ফোন মারফত আদান-প্রদান না হওয়াই ভাল।
অন্য প্রান্তে কিরীটী ফোন রেখে দিল।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই কিরীটী থানায় এসে হাজির হল।
বিকাশ তখন স্নান সেরে চাট্টি মুখে দিয়ে কোনমতে সবেমাত্র নিচের অফিসে এসে বসেছে।
আসুন মিস্টার রায়!
তারপর, বল। কিরীটী বসতে বসতে বললে, কতটুকু কি সংবাদ সংগ্রহ করলে?
প্রথম ব্যক্তি নিহত হয় নীল রুমালের ফাসে, ঠিক আজ থেকে দুমাস আগে এক শনিবার রাত্রি আটটা-নটার মধ্যে কোন এক সময়। কারণ—
কারণ? কিরীটী বিকাশের মুখের দিকে তাকাল।
রাত সোয়া আটটা নাগাদ শ্যামবাজার অঞ্চলে তার জুয়েলারির দোকান বন্ধ করে বেরুতে যাবেন শ্ৰীমন্ত পোদ্দার, ঠিক তখন একটা ট্যাকশি এসে থামে তার দোকানের সামনে–
বলে যাও।
লোকটির যে বর্ণনা দোকানের কর্মচারীদের একজনের কাছে পাওয়া গেছে তা হচ্ছে, লোকটি মধ্যবয়সী, রোগা। পাকানো চেহারা। পরনে দামী স্যুট ছিল।
আর কিছু? আর কোন বিশেষত্ব?
না, তেমন কিছু রিপোর্ট নেই আর।
হুঁ, বলে যাও।
০৫. বিকাশ সেন আবার শুরু করে
বিকাশ সেন আবার শুরু করে, আগন্তুক বলে, সে আসছে কোন এক বনেদী ধনীর বাড়ি থেকে। তার কর্তা তাকে পাঠিয়েছেন, কিছু গয়নার অর্ডার দেবেন; তাই তাকে একটিবার তার ক্যাটালগ বইটা নিয়ে তার সঙ্গে যাবার জন্য অনুরোধ জানান। শ্ৰীমন্ত পোদ্দার বলাই বাহুল্য, উৎফুল্ল হয়ে সেই আগন্তুকের সঙ্গে দোকান বন্ধ করে তারই ট্যাকশিতে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যান।
তারপর?
সারাটা রাত তিনি বাড়িতে ফেরেন না, কাজেই ছোট ভাই ও তার স্ত্রী ব্যস্ত হয়ে খোঁজখবর করেন।
অবিবাহিত ছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দার?
হ্যাঁ। তারপর যা বলছিলাম, পরের দিন সকাল ছটা নাগাদ তাকে গঙ্গার ধারে স্ট্র্যান্ড রোডে এক বেঞ্চির উপর এক ভদ্রলোক বেড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করেন। বেঞ্চির ওপর উপবিষ্ট শ্ৰীমন্ত পোদ্দার, গলায় নীল রুমালের ফাঁস-মৃত। তিনিই একজন প্রহরারত পুলিসকে ডেকে সংবাদটা দেন। পকেটে ছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দারের একটি ব্যাগে শদুই টাকা, গোটা দুই চেক-প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার, কিছু খুচরো পয়সা আর দোকানের চাবির গোছাটা।
অবিকল দেখছি তোমার শশধর সরকারের মতই ব্যাপারটা। স্রেফ হত্যার জন্যই হত্যা করা হয়েছিল শ্ৰীমন্ত পোদ্দারকেও তাহলে! কিরীটী বললে।
তাই তো দেখা যাচ্ছে।
তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি?
তাঁর নাম হারাধন সামন্ত। তারও জুয়েলারির একটা দোকান ছিল রাধাবাজারে। দোকানের নাম সামন্ত জুয়েলার্স। বছর চারেক হল সাজিয়ে-গুছিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গেই দোকনের পত্তন। শ্ৰীমন্ত পোদ্দাররের মৃত্যুর ঠিক কুড়ি দিন পরের ঘটনা, তিনিও রাত আটটার পর দোকান বন্ধ করতে যাবেন, সেই সময়–
আবার এক আগন্তুকের আবির্ভাব তো?
হ্যাঁ, তবে এবার ট্যাকশি নয়, একটা প্রাইভেট গাড়িতে চেপে তার আবির্ভাব ঘটে। কিছু দামী জড়েয়ার গয়না কিনবে, তাই এসেছিল। সঙ্গে হাতে ঝোলানো একটা কালো রঙের অ্যাটাচি কেস।