সত্যিই তাই রায় মশায়। ব্যাপরটা হচ্ছে—
বলুন?
আপনার নজরে পড়েছে কিনা জানি না, গত দুমাসের মধ্যে এই শহরে–
আপনি কি সেই নীল রুমালের ফাঁস লাগিয়ে যে সব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, সেই কথাই
ঠিক তাই। কিন্তু আশ্চর্য, বুঝলেন কি করে?
আপনি একজন নামকরা জুয়েলার বললেন না? যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তারাও সবাই জুয়েলার ছিলেন কিনা—
ঠিক। সেই কারণেই আমি এসেছি আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্য।
কীসের পরামর্শ বলুন তো?
আমার কেমন একটা ভয় ঢুকেছে মনে। কে জানে এবার আমারই পালা কিনা!
কিরীটী হেসে ফেলে।
হাসছেন যে রায় মশাই?
হাসছি এই কারণে, কলকাতা শহরে তো অনেক জুয়েলার আছেন, বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী শিবানন্দের বাঁ-হাতের মধ্যমায় মীনাকরা আংটিটার দিকে তাকিয়ে থেমে যায়।
শিবানন্দর দৃষ্টি এড়ায় না বোধ হয় ব্যাপারটা। বলেন, কি দেখছেন?
না, কিছু না। কি বলছিলেন বলুন?
বুঝতেই পারছেন রায় মশাই, ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি বড় নার্ভাস হয়ে পড়েছি–
কেন বলুন তো?
বলেন কি! বেটাদের যত আক্রোশ তো দেখছি সব আমাদের জুয়েলার্সদের ওপরেই। বেটারা যেন আমাদের সব খতম করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাই ভয়ে ভয়ে আছি সর্বক্ষণ। রাতে ঘুম নেই, আহারে রুচি নেই—জেগে জেগে যেন কেবলই ওই নীল রুমালের আতঙ্ক দেখছি, ভয়াবহ এক বিভীষিকা।
তা শিবানন্দবাবু, সেজন্য আমার কাছে এসেছেন কেন? আমি তো আর আপনাকে কোন প্রোটেকশান দিতে পারব না! তা যদি কেউ পারে তো পুলিসই পারবে।
তা কি আর জানি না রায় মশাই—
তবে?
পুলিস হয়ত আমার কথায় কানই দেবে না।
তা কেন? বলেন তো টালিগঞ্জ থানার ও. সি.-কে আমি বলে দিতে পারি—
না না, মশাই, বরং আপনি যদি কোন পথ বাতলাতে পারেন—
না, ক্ষমা করবেন। তাছাড়া—
আহা, সাহায্য না করতে পারেন, উপদেশ তো কিছু দিতে পারেন।
বাড়িতে গোটা দুই দারোয়ান রাখুন।
তা কি আর বাকি রেখেছি রায় মশাই-তিন-তিনজন দারোয়ান বহাল করেছি। তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছি না, স্বস্তিতে বাইর ঘোরা-ফেরা পর্যন্ত করতে পারছি না।
সুব্রত কিরীটীর পাশে বসে শিঃশব্দে এতক্ষণ শিবানন্দ বোসের কথাবার্তা শুনছিল। এবারে বললে, আপনি বরং এক কাজ করুন শিবানন্দবাবু–
কি বলুন তো?
মাসখানেকের জন্য কাউকে কোথায় যাচ্ছেন না জানিয়ে বাইরে কোথাও গিয়ে কাটিয়ে আসুন।
সেই পরামর্শ দিচ্ছেন!
হ্যাঁ। নীল রুমালের ব্যক্তিটির সত্যিই যদি আপনার উপরে কোন আক্রোশ থাকে তো মাসখানেক অন্তত তো আপনার খোঁজ পাবে না—
কিন্তু তারপর? সব কিছু ফেলে দিয়ে তো আমি অজ্ঞাতবাসে বাকি জীবনটা কাটাতে পারি না। তাছাড়া শেষ পর্যন্ত যদি তারা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলে।
শিবানন্দবাবু? কিরীটী আবার কথা বলে।
আজ্ঞে।
আপনার ছেলেমেয়ে কটি?
নেই।
নেই মানে? আপনার কোন সন্তানাদি নেই?
না। আমার স্ত্রীর কোন সন্তান হয়নি। দুঃখের কথা আর বলেন কেন?
তবে আপনার বিষয়-আশয়ের ওয়ারিশন কে?
কে আর–ওই নানু, বোম্বেটে ভাগ্নেটারই শেষ পর্যন্ত হবে পোয়া বারো!
ভাগ্নে!
হ্যাঁ, ভাগ্নে নয়—বলতে পারেন কুলাঙ্গার। লেখাপড়া করল না, মানুষ হল না, কাজকর্মও শিখল না। সর্বক্ষণ পার্টি করে বেড়ায়।
কোন পার্টির লোক তিনি?
কে জানে মশাই, এদেশে তো হাজারটা পার্টি। নামও জানি কি ছাই তার যে বলব কোন্ পার্টি শ্রীমানের। বুঝলেন, দিতাম গলা-ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে বাড়ি থেকে, কিন্তু ওই যে–
কি?
তার মামী–মামার অর্ধাঙ্গিনীটি, সে যে নানু বলতে অজ্ঞান। বলেছিলাম একবার তাড়িয়ে দেব, তা ঘন ঘন ফিট হতে শুরু করল গিন্নীর। শেষে সাপের ছুঁচো গেলার মত চুপ করে রামবুদ্ধ হয়ে বসে আছি। মরুক গে—যা খুশি ওরা করুক গে। অথচ মশাই, ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালই ছিল—
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। স্কুল-ফাইন্যাল পাস করে বিদ্যাসাগরে বি. এসি. পড়ছিল, তারপরই মাথায় ঢুকল পোকা। ব্যাস, সব কিছু শিকেই উঠল। এখন দিবা-রাত্র পাটি করছেন আর আমার অন্নধ্বংস, ধনক্ষয় করছেন।
কিরীটী মনে মনে বলে, ঠিকই করছে-বর্বরস্য ধনক্ষয়! কিন্তু মুখ দিয়ে তার সে কথাটা বের হল না, কেবল মিটিমিটি হাসে।
শিবানন্দ এবারে বললেন, আমি অবিশ্যি আপনার পরামর্শ এমনি চাই না, তার জন্যে পারিশ্রমিক দিতে আমি কার্পণ্য করব না—
ঠিক আছে শিবানন্দবাবু, আপনার কথাটা আমি ভেবে দেখব।
দেখবেন?
হ্যাঁ, দেখব।
ব্যস, ব্যস—তাহলেই আমি খুশি। বড় বিপদে পড়েছি রায় মশাই, এ বিপদ থেকে আপনি আমাকে উদ্ধার করুন—আমিও আপনাকে খুশি করে দেব। আচ্ছা, তাহলে আমি উঠি। নমস্কার।
নমস্কার।
শিবানন্দ অতঃপর উঠে পড়লেন এবং লাঠির সাহায্যে পঙ্গু ডান পা-টা সামান্য টেনে টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী একদৃষ্টে শিবানন্দর ক্রমঅপস্রিয়মাণ দেহটা ও চলার ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে ছিল।
সুব্রতর সেদিকে নজর পড়ায় বললে, কি দেখছিস রে কিরীটী?
কিরীটী সে কথায় জবাব না দিয়ে বলল, কেমন বুঝলি সুব্রত।
কীসের কি বুঝলাম?
বলছিলাম, ভদ্রলোকের আগমন ও প্রত্যাগমন থেকে কি তোর মনে হল!
বেশ ভয় পেয়ে গেছেন মনে হল।
তা ঠিক, তবে ওই যে একটা কথা আছে না আমাদের দেশে–
কি?
ভেক না নিলে ভিক্ষে মেলে না!
সুব্রতর কথার জবাব দেওয়া হল না, কৃষ্ণা এসে ঘরে প্রবেশ করল। হাতে তার প্লেটে গরম গরম সিঙাড়া।