তা পারব না কেন?
হ্যাঁ, খবরটা সংগ্রহ কর তো। ভাল করে সন্ধান নাও। আলোর বিন্দু হয়ত দেখতে পাব এক-আধটা, আর–
আর কি?
সংবাদপত্রের ওই বিজ্ঞাপনের কথাটাও যেন ভুলে যেয়ো না।
একটা কথা বলব মিস্টার রায়?
বল।
সংবাপত্রে প্রকাশিত ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে নীল রুমাল হত্যা-রহস্যগুলোর সত্যি কোন যোগাযোগ আছে বলে কি আপনি মনে করেন মিস্টার রায়?
নাও থাকতে পারে। হয়ত কোনটার সঙ্গেই কারও কোন সম্পর্ক নেই। কিরীটী মৃদু হেসে বললে।
তবে?
সেই যে একটা কবিতা আছে না—যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, মিলিলে মিলিতে পারে—কিন্তু আর না বিকাশ, এবার আমি একটু বেরোব।
বিকাশ বুঝতে পারে, কিরীটী আপাতত বর্তমান প্রসঙ্গের ওপরে যবনিকাপাত করতে চায়। কিরীটী রায়কে বিকাশ ভাল করেই চেনে। যতটুকু সে বলেছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার বেশি একটি কথা তার মুখ থেকে আর এখন বের করা যাবে না।
তাহলে আমিও উঠি।
এস।
বিকাশ সেন উঠে পড়ল।
০৩. ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে
ঘণ্টাখানেক বাদে কিরীটীও বের হচ্ছে দেখে কৃষ্ণা শুধোয়, বেরোচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ, একটু ডালহাউসি যাব।
সংবাদপত্র প্রত্যহের অফিসে বোধ হয়?
ঠিক।
তোমার কি সত্যিই মনে হয়–
কি?
ওই বিজ্ঞাপনটার সঙ্গে—
নীল রুমাল হত্যা-রহস্যের কোন যোগাযোগ আছে কিনা?
হ্যাঁ, মানে—
কিন্তু কৃষ্ণার কথা শেষ হল না, নিচের কলিংবেলটা বেজে উঠল। কৃষ্ণা বললে, ওই দেখ, আবার যেন কে এল! সুব্রত ঠাকুরপো বোধ হয়—
মনে হচ্ছে, না। তার বেল বাজানো ঠিক ওই রকম নয়।
ওই সময় জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!
কি রে?
একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।
ভদ্রলোক! কোথা থেকে আসছেন?
তা তো কিছু বললেন না, বললেন আপনার সঙ্গে কি বিশেষ দরকার আছে।
যা, ডেকে নিয়ে আয়।
জংলী নিচে চলে গেল। কৃষ্ণাও ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী তাকে সম্বোধন করে বললে, এখন আর বেরোব না।
সেই ভাল, ফুলকপির সিঙাড়া ভাজছিলাম–
সুব্রতকে খবর দিয়েছ?
কালই ফোনে বলেছি, এখুনি হয়ত এসে পড়বে।
ঠিক আছে, তুমি যাও।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। কিরীটী কান পেতে শোনে। দুজোড়া শব্দ। প্রথম শব্দটা জংলীর, তার সঙ্গে যে শব্দটা কানে আসে, সেটা থেমে থেমে-হাতে বোধ হয় একটা লাঠি আছে, লাঠির শব্দও কানে আসে।
সত্যিই তাই। পরমুহূর্তে জংলীর পেছনে পেছনে যে লোকটি ঘরে এসে প্রবেশ করে, তার বয়স খুব বেশি না হলেও দেখলে মনে হয় যেন অকালে বুড়ো হয়ে গেছে। রসকষহীন শুকনো পাকানো চেহারা, মুখটা লম্বাটে ধরনের, মুখে চাপদাড়ি, কণ্ঠার হাড় দুটো প্রকট, কপালে একটা জড়ল চিহ্ন। দুটি চোখে যেন শৃগালের মত অস্থির সতর্ক দৃষ্টি। ডান পা-টা মনে হয় পঙ্গু, হাতে একটা মোটা লাঠি। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি, গ্রে কলারের গরম সার্জের পাঞ্জাবির ওপর একটা দামী কাশ্মিরী সাল জড়ানো।
নমস্কার।
কিরীটী প্রতিনমস্কার জানায় হাত তুলে, নমস্কার বসুন।
হ্যাঁ, এই যে বসি। ভাঙা ভাঙা একটু যেন মোটা কর্কশ স্বর।
কোনমতে আগন্তুক কিরীটীর মুখোমুখি সোফাটার ওপরে বসে পাশে তার লাঠিটা রাখলেন। তারপর বললেন, আপনিই নিশ্চয় রায়মশাই?
হ্যাঁ।
আগন্তুক পকেট থেকে একটা দামী সোনার সিগারেট কেস বের করেন, কেস থেকে একটা দামী বিলাতী সিগারেট নিয়ে কেসটা কিরীটীর দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, সিগারেট!
না ধন্যবাদ।
সিগারেট চলে না বুঝি? ধূমপানে বুঝি অভ্যস্ত নন? তা ভাল, বড় বদ অভ্যাস–
চলে, তবে সিগারেট নয়—সিগার আর পাইপ।
সুদৃশ্য দামী একটা ম্যাচবক্স-হোলডার থেকে কাঠি বের করে সিগারটে অগ্নিসংযোগ করতে তৎপর হন আগন্তুক।
কিরীটী লক্ষ্য করে, আগন্তুকের দুহাতের তিন আঙুলে আংটি, তার মধ্যে ডান হাতের অনামিকায় যে আংটিটা রয়েছে সেটায় একটা বেশ বড় সাইজের হীরে বসানো রয়েছে এবং অন্য আংটি দুটো মীনে করা।
হীরেটার দাম খুব কম করেও হাজার দশেক তো হবেই। দামী হীরে। জ্বলজ্বল করছে। বেশভূষা, সোনার সিগারেট কেস, হাতের হীরের আংটি—সব কিছুই যেন নির্দেশ করছে যে আগন্তুক একজন ধনী ব্যক্তি।
সিঁড়িতে ওই সময় দ্রুত জুতো-পরা পায়ের শব্দ শোনা গেল।
কিরীটী বুঝতে পারে সুব্রত আসছে।
পরমুহূর্তই সুব্রত ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে ওঠে, বৌদি–
কিন্তু বাকি কথা সে শেষ করতে পারে না। ঘরের মধ্যে কিরীটীর সামনে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিকে দেখে থেমে গেল এবং সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকাল।
আয় সুব্রত, বস্।
বৌদি—
বস, এখনও দেরি আছে।
সুব্রত বুঝতে পারে, কিরীটী তাকে বসতে বলছে। আর কোন কথা না বলে সে কিরীটীর পাশেই বসে পড়ল।
হ্যাঁ এবারে বলুন তো আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন? প্রশ্নটা করে কিরীটী আগন্তুকের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
আমার নাম শিবানন্দ বসু। বালিগঞ্জে বোস অ্যান্ড কোং নামে যে জুয়েলারি শপটা আছে তার প্রোপ্রাইটার—মানে মালিক আমি।
তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো বোস মশাই?
ভদ্রলোক কেমন যেন একটু ইতস্তত করতে থাকেন। আড়চোখে সুব্রতর দিকে তাকান।
ও, সুব্রত আমার অন্তরঙ্গ ও সহকারী। আমাকে যা বলার, ওর সামনে আপনি তা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারেন শিবানন্দবাবু। তারপর একটু থেমে কিরীটী বললে, মনে হচ্ছে। বিশেষ কোন কারণে আপনি একটু চিন্তিত?