প্রত্যেককেই গলায় একটা করে নীল রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, তাই তো?
চমৎকার। আর কিছু? কিরীটী সহাস্যে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে তখনও।
আর!
হ্যাঁ, আর–, কিরীটীর কথা শেষ হল না, বাইরে গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল ওই সময়। কিরীটী বললে, ওই বোধ হয় আমাদের সেন সাহেব এল!
বাইরের কলিংবেল বেজে উঠল ওই সঙ্গে। শোনা গেল তার শব্দ।
জংলী! কিরীটী ডাকে।
বলুন। জংলী সাড়া দিল।
দরজাটা খুলে দাও, বোধ হয় বিকাশবাবু এলেন।
০২. চা-জলখাবার নিয়ে আসি
যাই, চা-জলখাবার নিয়ে আসি।
কৃষ্ণা সোফা ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরেই সিঁড়িতে একটা ভারী জুতোর মচমচ শব্দ শোনা গেল।
মোটা মানুষ বিকাশ সেন, বৌবাজার থানার ও. সি.সিঁড়ি ভাঙার পরিশ্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল।
এস বিকাশ!
বিকাশ ধপ করে একটা সোফার উপরে বসতে বসতে বললে, বাপস! বলুনএবারে রায় সাহেব, ঊর্ধ্বশ্বাসে একেবারে ছুটে আসছি জীপ নিয়ে!
কিরীটী হাসল।
হাসছেন আপনি! আর এদিকে—
দেহের ওজনটা একটু কমাতে পার না? তাহলে আর হাঁপাতে হয় না!
আপনিও ওই কথা বলবেন রায় সাহেব! ঘরে-বাইরে যদি ওই একই কথা শুনতে হয়—
কেন হে, ঘরে আবার তাগিদ দিচ্ছে কে?
কে আবার! সখেদে বলল বিকাশ, তাগিদ দেবার যার ক্ষমতা বা অধিকার আছে।
বল কি, ভদ্রমহিলাও তোমার পেছনে লেগেছেন?
অথচ জানেন, গত আট মাসে আমার বিশ সের ওয়েট কমে গেছে! এভাবে ওয়েট কমতে থাকলে
তাই নাকি? তা আট মাস পূর্বে কত ছিল—কত?
আড়াই মণও নয়—ছ’মাসের কম।
কিরীটী গম্ভীর হবার চেষ্টা করে কোনমতে হাসি চেপে বলে, তাহলে তো সত্যিই যথেষ্ট কমে গেছে!
বলুন তাহলে—আরও কমলে হাঁপ ধরবে না? স্রেফ ব্যাঙাচিতে—
নির্ঘাত পরিণত হবে।
আমার পরিবারটিকে একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন, মোটা না হয় একটু আমি সামান্যই, তাহলেও আমার মত অ্যাকটিভ অফিসার কজন আছে উপরিওয়ালারা, বলুন তো!
তা কথাটা মিথ্যা নয়, মোটাসোটা হলে কি হবে, বিকাশ সেন সত্যিই খুব কর্মঠ অফিসার, সরকারী মহলে যথেষ্ট নামও আছে, কিরীটীর সেটা অজানা নয়।
যাগগে ওসব কথা, বলুন এখন-হঠাৎ আসতে বললেন কেন ফোন করে—
বসো বসো, আগে চা-জলখাবার খেয়ে সুস্থ হও।
কৃষ্ণা ওই সময় একপ্লেট সন্দেশ ও চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
কেমন আছেন বিকাশবাবু? কৃষ্ণা প্রশ্ন করে।
নমস্কার বৌদি। ভাল, চমৎকার। কেবল চারদিকে বদমাশ শয়তানগুলো জ্বালাতন করে মারছে। এই দেখুন না, গত পরশু একজন আবার নীল রুমালের ফাসে খতম হয়েছেন—আর হবি তো হ আমারই চৌহদ্দির মধ্যে।
ভাল কথা বিকাশ, সেই নীল রুমালটা এনেছ? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, এই যে—বলতে বলতে পকেট থেকে ছোট একটা কাগজের প্যাকেট বের করল বিকাশ সেন।
কিরীটী হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল। নাও শুরু কর বিকাশ।
বিকাশকে বলবার আগেই সে প্লেটটা টেনে নিয়েছিল।
কিরীটী কাগজের মোড়কটা খুলতেই একটা দামী বিলাতী সেন্টের গন্ধের ঝাপটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের নাকে এসে লাগল। নীল রঙের—আকাশ-নীল রঙের একটা বড় সাইজের রেশমী রুমাল।
কিরীটী রুমালটা মেলে ধরে দেখতে দেখতে বললে, হুঁ, হত্যাকারী মহাশয় দেখছি। রীতিমত সৌখীন ব্যক্তি! বন্দুক, রিভলবার, ছোরাছুরি নয়—একেবারে একটি সেন্টনিষিক্ত আকাশ-নীল রঙের রেশমী রুমালকেই হাতিয়ার করেছেন! জেনুইনিটি আছে বলতে হবে, কি বল বিকাশ?
একটা বড় আমসন্দেশ গালে পুরে চিবুতে চিবুতে বিকাশ বললে, তা যা বলেছেন। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা, যে রেটে এ শহরে নীল রুমালের আবির্ভাব ঘটতে শুরু করছে, শেষ পর্যন্ত না আমাদের পুলিশ মহলের কণ্ঠদেশেই তা চেপে বসে!
কিরীটী হো-হো করে হেসে ওঠে বিকাশের কথায়।
বিকাশ আর একটা সন্দেশ মুখে পুরতে পুরতে বলে, অতি উপাদেয়, কোথাকার সন্দেশ বৌদি? কোন্ দোকানের?
কৃষ্ণা জবাব দেয়,–দোকানের নয়।
তবে?
আমার হাতে তৈরি।
আঃ! কি ইচ্ছা করছে জানেন বৌদি?
কি? সহাস্য মুখে তাকাল কৃষ্ণা বিকাশ সেনের দিকে।
হাত দুটো আপনার সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিই।
কিরীটী আর কৃষ্ণা দুজনেই হাসে।
সন্দেশের রেকাবিটা নিঃশেষ করে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিতে নিতে বিকাশ বললে, কি কিরীটীবাবু, রুমালটা থেকে কিছু হদিস পেলেন?
আপাতত যা মনে হচ্ছে, তা হচ্ছে রুমালের সাধারণত যা সাইজ হয়ে থাকে তার থেকে কিছু বড়। সাধারণ সিল্কের রুমাল আর এক কোণে রুমালটার সাঙ্কেতিক ইংরাজী অক্ষর 3 লেখা ছাড়া বিশেষ কোন হদিস মিলছে না, তবে–
তবে?
ওই 3 সাঙ্কেতিক অক্ষরটিকে যদি বিশেষ একটা ইঙ্গিত বলে ধরে নেওয়া যায় তো বলতে হবে
বিকাশ সাগ্রহে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধাল, কি মিস্টার রায়?
পরশুর হত্যাটি নিয়ে যে তিনটি হত্যাকাণ্ড এই দু মাসে এই শহরে সংঘটিত হয়েছে। এই ধরনেরই নীল রুমালের সাহায্যে, সেগুলির মধ্যে অর্থাৎ সেই হত্যাকাণ্ডগুলির মধ্যে একটা বিশেষ যোগাযোগ বা যোগসূত্র হয়ত আছে।
ঠিক। আমারও তাই মনে হয়েছিল। একই ব্যক্তির দ্বারা সব কটি হত্যাকাণ্ডই সংঘটিত হয়েছে মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ।
অর্থাৎ হত্যাকারী একই ব্যক্তি, এই তো বলতে চান আপনি? বিকাশ বললে।
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বললে, মনে হচ্ছে তো সেই রকমই।
কিন্তু একটা কথা–, বিকাশ বলে।