কৃষ্ণা বললে, পড়লে?
কিরীটী বললে মৃদু কণ্ঠে, হুঁ।
মনে হল কিরীটী যেন কি ভাবছে।
সত্যিই কিরীটী ভাবছিল। হঠাৎ কাগজটা রেখে কিরীটী উঠে সোজা গিয়ে ঘরের কোণে রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করতে লাগল বৌবাজার থানায়।
থানা-অফিসার বিকাশ সেন তার পরিচিত।
বিকাশ থানাতেই ছিল, সে-ই ফোন ধরে অপর প্রান্তে। ও. সি. বৌবাজার থানা স্পিকিং–
কে, বিকাশ? আমি কিরীটী।
আরে, মিস্টার রায়! কি খবর? হঠাৎ?
কাগজে দেখলাম, তোমার এলাকায় কে একজন শশধর সরকার পরশু রাত্রে খুন হয়েছে!
হ্যাঁ, আবার সেই নীল রুমাল মিস্টার রায়—
জানি। তা কোনকিছুর কিনারা করতে পারলে বা হদিস করতে পারলে?
না। তবে—
কি?
তার গলায় পেঁচানো ছিল যে নীল রুমালটা, যার সাহায্যে বেচারীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, সেই রুমালটা পরীক্ষা করতে করতে একটা জিনিস নজরে পড়েছে, জানেন মিস্টার রায়?
কি বল তো?
ছোট্ট করে লাল সুতোয় লেখা একটা সাঙ্কেতিক ইংরাজি অক্ষর ‘3’ অর্থাৎ তিন।
আমিও ঠিক ওই কথাটাই তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম বিকাশ। যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।
মানে?
টেলিফোনে সব কথা হতে পারে না। তোমার হাতে যদি সময় থাকে তো চলে এস একবার আমার বাড়ি।
যাবার কথা যখন আপনি বলছেন, তখন হাতে হাজার কাজ এবং সময় না থাকলেও যেতে হবে। আমি এখুনি আসছি। বলে বিকাশ টেলিফোনটা রেখে দিল অপর প্রান্তে।
কিরীটীও রিসিভারটা নামিয়ে রেখে পুনরায় সোফায় এসে বসল।
কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার? কাকে আসবার জন্য জরুরী তাগিদ দিলে গো ফোনে?
বৌবাজার থানার ও. সি. আমাদের বিকাশ সেনকে।
আমাদের বিকাশবাবু!
হ্যাঁ। ও হয়ত এখুনি এসে পড়বে। তুমি বরং কিছু ভালমত জলখাবারের ব্যবস্থা কর কৃষ্ণা। জান তো, বিকাশ সেন কিরকম পেটুক মানুষ!
কৃষ্ণা হেসে বলে, জানি, সে ব্যবস্থা হবেখন। কিন্তু ব্যাপারটা কি বল তো? হঠাৎ এত জোর তলব কেন ভদ্রলোকটিকে?
আজকের সংবাদপত্রে দ্বিতীয় পৃষ্ঠার অ্যাডভার্টাইজমেন্ট—বিজ্ঞাপনের পাতাটা দেখ। একটা বিজ্ঞাপন আছে নিশ্চয়ই, যদি আমার অনুমান মিথ্যা না হয় তো!
বিজ্ঞাপন? কীসের বিজ্ঞাপন? কৃষ্ণা যেন একটু বিস্ময়ের সঙ্গেই শুধায়।
বেদ পাঠের। কিরীটী মৃদু হেসে বলল।
মানে?
আহা, দেখই না আগে বিজ্ঞাপনটা আছে কিনা!
কৃষ্ণা বিনা বাক্যবায়ে অতঃপর সংবাদপত্রটা তুলে নিয়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠাটা খুলে চোখ বুলোতে শুরু করে।—এ তো দেখছি বিবাহ, হারানো প্রাপ্তি ও নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনেই পাতা ভর্তি! দেখতে দেখতে বলে কৃষ্ণা।
তোমার চোখে দেখছি চালসে পড়েছে কৃষ্ণা! ডাঃ জিতেন চক্রবর্তীর কাছে একদিন তোমাকে না নিয়ে গেলে চলছে না! কাগজটা দাও, দেখাচ্ছি। আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো-নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনটা আছে আজকের কাগজেও।
কৃষ্ণার হাত থেকে কিরীটী হাত বাড়িয়ে কাগজটা টেনে নিল।
কয়েক মুহূর্ত চোখ বুলিয়েই কিরীটী বলে উঠল, বলছিলাম না—নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপনটা বের হয়েছে, এই দেখ—
দেখ! বলে কৃষ্ণা কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়ল।
পৃষ্ঠার মাঝামাঝি কলমে সত্যিই একটা বক্স-করা বিচিত্র বিজ্ঞাপনের প্রতি কিরীটী অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, পড়।
কৃষ্ণা ঝুঁকে পড়ল।
একটা বাক্স-করা বিজ্ঞাপন পাইকা টাইপে ছাপা হয়েছে ছোট কবিতার মত।
এ যে দেখছি একটা কবিতা!
আহা, পড়ই না।
একে চন্দ্র অস্তমিত
দুইয়ে পক্ষ কর্তিত
তিনে নেত্র উৎপাটিত
চারে বেদ পঠন-পাঠন
যা হলেই সমাধান।
নতুন কিতাবে নতুন ছড়া
শীঘ্রই প্রকাশ হচ্ছে—
কৃষ্ণা বার-দুই পড়ল বিচিত্র বিজ্ঞাপনটা। তারপর বললে, নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপন মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ। কিরীটী মৃদু হেসে বলে, নতুন এক কিতাবই বটে! রক্তের হরফে লেখা হচ্ছে। শেষ পরিচ্ছদটি কেবল এখন বাকি। সেটি লেখা হলেই অর্থাৎ সমাপ্ত হলেই পুস্তকটি শেষ!
কৃষ্ণা বুঝতে পারে বিজ্ঞাপনের মর্মার্থটা সে ঠিক উদ্ধার করতে পারেনি। তাই বলে, মনে হচ্ছে ওই বিজ্ঞাপনের মধ্যে কোন রহস্যের গন্ধ তুমি পেয়েছ!
রহস্য বলে রহস্য—মারাত্মক রহস্য! তবে বেচারী এখনও বুঝতে পারেনি—
কি?
অতি দম্ভে যেমন লক্ষাধিপতি হত হয়েছিল, তেমনি তারও মৃত্যুবাণ তার অতি দম্ভের ছিদ্রপথে বের হয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে আবার বলে, কিছুদিন ধরেই ওই বিজ্ঞাপনটা বেরোচ্ছিল, তবে শেষ দুটি লাইন আজই যোগ করা হয়েছে এবং সমাপ্তির রেখা টানার ইঙ্গিতটি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
কার কথা বলছ?
মেঘের আড়ালে থেকে যিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, সেই মেঘনাদের কথা!
ঠিক আছে, তুমি হেঁয়ালিই গাও, আমি চললাম। কৃষ্ণা রাগতভাবে উঠ দাঁড়ায়।
আরে বসো বসো, চটছ কেন?
না, যাই-বিকাশবাবুর খাবারের ব্যবস্থা করি গে।
সে হবে’খন। বসো না।
কৃষ্ণা আবার সোফায় বসে পড়ে।
কিরীটী বলে, সংবাদপত্রে তোমার নজর পড়েছে কিনা জানি না, গত দুমাসে আরও দুজন জুয়েলার এই শহরে খুন হয়েছে–
সে তো হচ্ছেই কত!
তা হচ্ছে, তবে ওই পূর্বের দুটি খুন ও গতকালের খুনের মধ্যে দুটো বিশেষত্ব আছে এবং বিশেষত্ব একটা অঙ্কের মত–
কি রকম?
এক নম্বর হচ্ছে, যে দুজন গত দুমাসে নিহত হয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই ধনী ব্যক্তি শহরের মধ্যে এবং প্রত্যেকেই ব্যবসায়ী; শুধু ব্যবসায়ীই নয়, সোনা-রুপার ব্যবসায়ী, অর্থাৎ জুয়েলার্স ছিল। দু নম্বর, একটু থেমে মৃদু হেসে বলে, দু নম্বর—বল তো কি? স্মিত হাস্যে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল কিরীটী।