রথীন জানতেন কিরীটীকে, তার শক্তির কথা জানতেন—ইতিপূর্বে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের কোন সুযোগ না ঘটলেও। কাজেই তিনি আর দ্বিরুক্তি করেন না। সঙ্গের পুলিসপ্রহরীর জিম্মায় আপাতত দোকানঘর ও মৃতদেহ রেখে বাইরে এসে বিকাশেরই জীপেই উঠে বসল সকলে।
বিকাশই জীপ চালাচ্ছিল। শুধালে, কোন দিকে যাব?
বেলগাছিয়ায়।
বিকাশ বিনা বাক্যব্যয়ে জীপে স্টার্ট দিয়ে এগোতে লাগল।
সকাল নটা বাজে প্রায় তখন।
সুব্রতর কাছে তখন সমস্ত ব্যপারটা যেমন ঝাপসা, তেমনি অস্পষ্ট। সে বুঝতে পারছিল না, কিরীটী কেন বেলগাছিয়ায় চলেছে।
রাস্তায় আর কথা হল না। কেউ জিজ্ঞাসাও করে না, কেন তারা বেলগাছিয়ায় চলেছে!
সকালের দিকে রাস্তায় তখনও তেমন ভিড় জমে ওঠেনি।
বেলা পৌনে দশটা নাগাদ ওরা বেলগাছিয়া ব্রীজ ক্রস করে একটা সরু রাস্তার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে কিরীটীর নির্দেশে সকলে নামল।
রথীনবাবু, আপনার সঙ্গে পিস্তল আছে?
আছে। রথীন জবাব দেন।
চলুন।
১০. সরু রাস্তাটা থেকে সকলে
সরু রাস্তাটা থেকে সকলে এসে একটা অপ্রশস্ত গলির মধ্যে প্রবেশ করল।
আগে আগে কিরীটী, পশ্চাতে ওরা তিনজন। নিঃশব্দে ওরা তিনজন কিরীটীকে অনুসরণ করে।
একটা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল।
বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কলিংবেলটা টিপতেই একজন প্রৌঢ় ভৃত্য এসে দরজা খুলে দিল।
কিন্তু লোকটা চারজনের মধ্যে পুলিসের পোশাক পরা দুজনকে দেখে হঠাৎ যেন কেমন বোবা হয়ে যায়।
তোমার মা বাড়িতে আছেন?
মা!
হ্যাঁ। আছেন? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
আছেন। লোকটি বলে।
কোথায়?
দোতলায়। খবর দেব?
না। আসুন রথীনবাবু, এস বিকাশ। বলে কিরীটীই প্রথমে দোতলার সিঁড়ির দিকে। এগিয়ে যায়।
ভৃত্যটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুলিসের লোক বলে বাধা দিতে সাহস পায় না বোধ হয়।
দোতলায় উঠতেই সামনের ঘরের ভেজানো দরজা ঠেলে যে ভদ্রমহিলা ওদের সামনে এসে দাঁড়াল, বিকাশ ও রথীন তাকে চিনতে না পারলেও সুব্রত তাকে চিনতে পারে।
নমস্কার সঞ্চারিণী দেবী। চিনতে পারছেন! কিরীটীই কথা বললে।
সঞ্চারিণী বিশ্বাসের মুখের ভাবটা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, না তো।
চিনতে পারছেন না। কয়েকদিন আগেই তো আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল।
কোথায় বলুন তো?
বলছি। আপনার তিনিটি নিশ্চয় এখানেই আছেন?
তিনি!
হ্যাঁ, হীরেন সরকার?
তিনি এখানে থাকতে যাবেন কেন?
যে কারণে আপনি সেদিন তার ওখানে ছিলেন, সেই কারণেই হয়ত তিনিও আপনার এখানে! সরে দাঁড়ান, আমরা ঘরে যেতে চাই
ঘরে যাবেন!
কেন, আপত্তি আছে? কিরীটী শুধোয়।
তা আছে বৈকি! বিনা ওয়ারেন্টে আমার ঘরে আপনাদের ঢুকতে দেব কেন?
মিথ্যে চেষ্টা করছেন সঞ্চারিণী দেবী। তাকে পালাবার সুযোগ আপনি করে দিতে পারবেন না। কারণ আমি জানি, ওই সিঁড়ি ছাড়া দোতলা থেকে নামবার আর কোন রাস্তা নেই। এ বাড়িটার detils আপনাদের থিয়েটারেরই এক অভিনেত্রীর কাছ থেকে পূর্বাহেই আমার সংগ্রহ করা আছে।
সঞ্চারণী বিশ্বাস যে বোবা।
সরে দাঁড়ান। সঞ্চারিণী সরে দাঁড়াল। সকলে ঘরে প্রবেশ করল।
শয্যার ওপরে কে যেন পেছন ফিরে আগাগোড়া একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
কিরীটী মুহূর্তকাল দাঁড়াল, তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে এক হেঁচকা টান দিয়ে কম্বলটা ফেলে দিতেই যে লোকটি উঠে বসল সে হীরেন সরকার।
হীরেন সরকার বলে ওঠে, কে আপনারা? এসবের মানে কি?
হীরেনবাবু, নমস্কার। এঁরা দুজন থানা-অফিসার, আর আমাকে আপনার না চেনার কথা নয়–
না, আপনাকে আমি চিনি না—never seen you before in my life!
সুব্রতও অবাক হয়ে হীরেন সরকারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
কিরীটী আবার ব্যঙ্গভরে বলে ওঠে, চিনতে পারছেন না? আশ্চর্য! আমার বাড়িতে গিয়ে আমার মুখোমুখি বসে শিবানন্দ বোস সেজে অত কথা বলে এলেন, আর এর মধ্যেই সব ভুলে গেলেন? না না, তাও কি হয়!
কি আবোল-তাবোল বকছেন মশাই! আট মাসের ওপর আমি
আপনি পঙ্গু-শয্যাশায়ী, তাই না? আর তাতেই বুঝি খোসমেজাজে একবার ল্যান্সডাউনের বাড়িতে আর একবার এখানকার বাড়িতে যাতায়াত করে থাকেন? শুনুন হীরেনবাবু, আর যার চেখেই ধুলো দিন না কেন, কিরীটী রায়ের চোখে আপনি ধুলো দিতে পারেন নি। প্রথম দিনই মোলাকাতের সময় আমার ওখানে আপনার সত্যকার পরিচয়টা আমার চোখের সামনে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
হীরেন সরকার বাবা।
হ্যাঁ, আপনার হাতের মীনা করা একটা আংটি-ওই যে এখনও আপনার ডান হাতের অনামিকায় রয়েছে বাংলায় ওপরে লেখা হীরেন-অন্য আংটিগুলো পরার সময় ওটা যদি খুলে রেখে যেতেন। কিন্তু এখন তো বুঝত পারছেন, পাপ আর গরল চাপা দেওয়া যায় না!
সকলেরই দৃষ্টি গিয়ে পড়ল আংটিটির ওপরে।
সত্যিই আংটিটার ওপরে মীনা করা হীরেন নামটা।
সহসা হীরেনের চোখমুখে একটা হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। সে কালো কালো একঝাক দাঁত বের করে বললে, বেশ মেনে নিলাম, আপনার ওখানে শিবানন্দ ছদ্ম পরিচয়ে আমি গিয়েছিলাম। তা তাতে হয়েছেটা কি।
আর কিছুই হয়নি, কেবল ধরা পড়ে গেছেন।
ধরা পড়ে গেছি!
হ্যাঁ। আপনিই যে শ্ৰীমন্ত, হারাধন, শশধর ও শিবানন্দর হত্যাকারী—