ভুল হয়ে গেল।
হ্যাঁ। ভেবেছিলাম, হত্যাকারী এবারে আরও সতর্ক হবে। কিন্তু দেখলাম, হাতের পাঁচ আর সে হাতে রাখতে চায় না—আগেভাগে মিটিয়ে দিয়ে প্রোগ্রামটা তার খতম করতে চায়। তা সংবাদটা পেলে কখন? কার কাছে?
রথীন তালুকদার তো এখানকার থানার ও. সি.-সেই-ই আমাকে ঘণ্টাখানেক আগে জানাতেই সেখানে গিয়ে ব্যাপারটা চাক্ষুষ দেখে সংবাদটা দিতে আমি ছুটে এসেছি আপনার কাছে।
রথীনবাবু কখন জানতে পারলেন?
শেষ রাত্রে।
কি করে জানলেন?
Some unknown person ভোররাত সাড়ে তিনটে নাগাদ তাকে ফোন করে সংবাদটা দেয়–
কি সংবাদটা দিয়েছিল?
Rather interesting! ফোনে তাকে বলে, ও মশাই থানা-অফিসার, ঘুমোচ্ছেন এখনও? আপনার এলাকায় যে নীল রুমাল ফস পরিয়েছে—বোস অ্যান্ড কোং জুয়েলারি শপের প্রোপ্রাইটারকে। বলেই ফোন কনেকশান কেটে দেয়। বুঝতেই পারছেন, এ শহরের সব থানা-অফিসারদের মধ্যে আমাদেরও এ নীল রুমালকে কেন্দ্র করে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল—প্রত্যেকেই যেন আমরা দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। তাই ফোনটা পাওয়া মাত্রই রথীন কালবিলম্ব না করে তখুনি ছুটে যায়।
তারপর?
দোকানঘরের কোলাপসিবল গেটে তালা দেওয়া ছিল না, রথীন দুজন কনেস্টবল নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখল, ঘরের ভেতরে আলো জ্বলছিল–
দারোয়ান-কোন দারোয়ান ছিল না?
না, দোকানে রাত্রে যে দারোয়ানটি পাহারায় থাকত, তার কোন পাত্তাই নেই। পরে অবিশ্যি তাকে মুখ ও হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় দোকানের পেছনে একটা ঘরে পড়ে থাকতে দেখা যায়-গোঁ গোঁ করছিল, যাক যা বলছিলাম, দোকানের কোলাপসিবল গেটটায় তালা দেওয়া ছিল না, কেবল টানা ছিল।
রতীনবাবু কি করলেন?
ওই সময় সুব্রত এসে ঘরে ঢুকল।
বিকাশ বলতে থাকে, সে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকল ভেতরে আলো জ্বলতে দেখে। দোকানের মধ্যে সব আললাগুলো জ্বলছে। তীব্র চোখ-ঝলসানো আলোতেই চোখে পড়ল, কাউন্টারের সামনেই শিবানন্দ বসুর মৃতদেহটা পড়ে আছে। তার গলায় ফাঁস দেওয়া একটি আকাশ-নীল রঙের রুমাল।
রুমালটা দেখেছেন আপনি?
হ্যাঁ, সেই একই ধরনের রুমাল। এবং রুমালের কোণে ইংরাজি সাঙ্কেতিক অক্ষর 4 লেখা এবারে।
মৃতদহ এখন কোথায়?
দোকানেই পড়ে আছে। দোকানে পুলিস-প্রহরা বসানো হয়েছে। রথীন আমার অনেককালের বন্ধু। সে-ই দোকান থেকে আমাকে ফোন করায় তার থানায় আমি ছুটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আপনার কাছে ছুটে এসেছি সংবাদটা আপনাকে দিতে।
চল, একবার যাওয়া যাক সেখানে।…একটু অপেক্ষা কর বিকাশ, আমি এখুনি আসছি।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
এবং মিনিট কয়েক পরেই বিকাশের জীপেই কিরীটী ও সুব্রতকে নিয়ে বিকাশ রওনা হল।
গাড়িতেই বসে সুব্রত সব শুনল।
.
দোকানের মধ্যে তখনও রথীন ছিলেন।
তিনি নানাভাবে দারোয়ানটাকে প্রশ্ন করছেন তখন, অনেক কষ্টে তার জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। বেচারা কেবলই বলছে, দোহাই হুজুরের, সে কিছু জানে না। রাত সোয়া দুটো কি আড়াইটে নাগাদ তার মালিক এসে তাকে ডাকাডাকি করতেই সে ঘুম থেকে উঠে দোকানের গেট খুলে দেয়।
তারপর কি হল, বল?
আমি দরজা খুলে দিলাম, মালিক দোকানে এসে প্রবেশ করলেন।
তারপর?
তারপর তাজ্জব কি বাৎ! মালিক সহসা আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার মাথায় একটা ভারী ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করতেই আমি পড়ে যাই—জ্ঞান হারাই। তারপর আর কিছু জানি না।
কিরীটী বললে, রথীনবাবু, কিছু চুরি বোধ হয় যায়নি?
ঠিক বলতে পারছি না, তবে কোন তালা বা আয়রন সেফের তালা তো ভাঙা দেখছি না।
হুঁ! মৃতদেহটা কোথায়?
ওই যে কাউন্টারের পেছনে।
হঠাৎ ওই সময় কিরীটীর নজরে পড়ে কাউন্টারের নিচে কি যেন একটা পড়ে আছে। ঝুঁকে জিনিসটা তুলে দেখেই চমকে ওঠে। কিন্তু সে কিছু না বলে সবার অলক্ষ্যে সেটা পকেটে রেখে দেয়।
অতঃপর সকলে উঁচু কাউন্টারের পেছনে এগিয়ে গেল।
মৃতদেহটা তখনও উপুড় হয়ে পড়ে আছে। রেশমী রুমালটা কেবল গলা থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে। গায়ে একটা শাল জড়ানো, পরনে ধুতি।
কিরীটী মুহূর্তকাল মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গিয়ে আরও সামান্য একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে মৃতদেহটা উলটে দিতেই মৃতদেহটা চিৎ হয়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর মুখ দিয়ে একটা বিস্ময়সূচক শব্দ বের হয়ে এল, এ কি!
কি হল? একই সঙ্গে রথীন, সুব্রত ও বিকাশ প্রশ্নটা করে।
না, কিছু না। কিরীটী বললে।
সুব্রত এতক্ষণে চিনতে পারে। কিছুদিন আগে শশধরের মৃত্যুর পরদিন শিবানন্দ বসু পরিচয়ে যে আতঙ্কিত খঞ্জ ভদ্রলোকটি কিরীটীর গৃহে গিয়েছিল এ সে লোক নয়।
সুব্রত বলে, তাই তো! এ কে তাহলে?
রথীনের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী শুধাল, আর ইউ সিওর রথীনবাবু, ইনিই শিবানন্দ বসু?
নিশ্চয়ই। দারোয়ান সনাক্ত করেছে, শিবানন্দর ছেলে একটু আগে এসেছিল, সেও তো সনাক্ত করে বলে গেছে, এ তারই বাপ। রথীন বললেন।
তবে, কিরীটী যেন মুহূর্তকাল কি চিন্তা করে। তারপর বলে, রথীনবাবু, এখুনি আমাদের বেরোতে হবে।
কোথায়?
হত্যাকারীকে ধরতে চান তো?
হত্যাকারী। সে কি আর এতক্ষণ ত্রিসীমানায় কোথাও আছে?
ত্রিসীমানায় না থাকলেও মহাশয় ব্যক্তিটি তার নিজস্ব ডেরায় সুস্থ বহাল তবিয়তেই নিশ্চিন্তে বসে বা শুয়ে আছে।
কি বলছেন?
হ্যাঁ, চলুন—আর দেরি নয়। চল বিকাশ।