.
পরের দিন সকালে কিরীটীর যখন নিদ্রাভঙ্গ হল, অনেক বেলা হয়ে গেছে, বেলা প্রায় সাতটা।
প্রচুর রোদে ঘর ভরে গেছে।
কৃষ্ণা বার-দুই এসে চা নিয়ে ফিরে গেছে। ঘুমোচ্ছে দেখে কিরীটীকে আর ডাকেনি।
সাতটা নাগাদ কিরীটীর ঘুম ভাঙতেই দেখে ঘরে ঢুকছে কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা বললে, চা আনি?
কিরীটী বললে, হ্যাঁ, নিয়ে এস। কিন্তু ডাকনি কেন, এত বেলা হয়ে গেছে!
কৃষ্ণা বললে, তুমি হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি চা আনি।
সুব্রত উঠেছে?
কখন! বিকাশবাবু তো কোন্ সকালেই এসে হাজির—তার সঙ্গে বসে গল্প করছে।
বিকাশ এসেছে! যাক, নচেৎ আমাকেই যেতে হত তার ওখানে।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
কিরীটী হাত মুখ ধুয়ে বসবার ঘরে এসে যখন ঢুকল, সুব্রত তখন বিকাশ সেনকে তাদের গতরাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বিবৃত করছিল।
কিরীটীকে ঘরে ঢুকতে দেখে বিকাশ বললে, সরকার-বাড়ির সব ঠিকুজি নক্ষত্র যোগাড় করে ফেলেছি, রায়সাহেব!
বসতে বসতে মৃদু হেসে বলল কিরীটী, চা-জলখাবার হয়েছে?
মিসেস রায় কি বাকি রেখেছেন তা—অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।
জংলী ওই সময় ট্রেতে করে তিন কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে এসে ঘর প্রবেশ করল।
চা-পান করতে করতে কিরীটী বললে, বল, এবার শোনা যাক, কি সংবাদ সংগ্রহ করলে!
তিন ভাই-বিকাশ বললে।
তা তো জানি।
শুনেছেন তাহলে? মেজ ভায়ের কোন সন্তানাদি ছিল না। বড় ভায়ের দুই ছেলে নীরেন্দ্র, হরেন্দ্র আর ছোট ভাইয়ের এক ছেলে হীরেন্দ্র।
তা আগেই শুনেছি, কিন্তু হরেন্দ্র এবং নীরেন্দ্র এখন কি করছে? কি করে তাদের চলে, জানতে পারলে কিছু?
হীরেন্দ্র অসুস্থ, পক্ষাঘাতে পঙ্গু। কারও সঙ্গে দেখা করে না।
তাও জানি। আর বাকি দুজন?
ওদের মধ্যে দেখলাম, সদ্ভাব নেই। বিজনেস গুটিয়ে ফেলবার পর—যদিও একই বাড়িতে থাকে এখনও, ধার-দেনা শোধ করেও যা অবশিষ্ট ছিল তাও কম নয়। কলকাতার ওপরে খান-দুই বাড়ি। একটা ল্যান্সডাউন মার্কেটের সামনে, অন্যটা শ্যামবাজার অঞ্চলে। নীরেন্দ্র ও হরেন্দ্রর ভাগে শ্যামবাজারের বড় বাড়িটা পড়ল, ছোট বাড়িটা পেল হীরেন্দ্র। নগদ টাকাও ওদের কিছু ছিল, তা ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেল।
তারপর? কিরীটী শুধায়।
নীরেন্দ্র বড় ভাই ওদের মধ্যে, কোনমতে সামলে-সুমলে নিয়ে এখন পুরাতন মোটরের বেচা-কেনার ব্যবসা করে। মোটামুটি ভালই চলে যাচ্ছে। হরেন্দ্রর আগে থাকতেই রেস খেলার নেশা ছিল, এখনও আছে। সংসারে স্ত্রী ও দুটি মেয়ে, দুটিই বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে। শ্যামবাজারের বাড়ির নিচের তলাটা নিয়ে সে থাকে।
সংসার চলে কি করে তার? রোজগারপত্তর কি?
সেটাই আশ্চর্য! কিছুই তেমন করে না—যতদুর সংবাদ পেয়েছি। তবে বেশ। সচ্ছলতার সঙ্গেই চলে যায় বলে মনে হল। কিন্তু বেশি প্রশ্ন করতে পারিনি।
কেন?
যেমন ষণ্ডাগুণ্ডা মার্কা চেহারা, তেমনি কাঠগোঁয়ার, বদমেজাজী। মানে মানে সরে এসেছি।
আর নীরেন্দ্র।
ভদ্রলোক যথেষ্ট অমায়িক, ভদ্র। বললেন, দেখুন না, বরাতের ফের—কি ছিলাম আর কি হয়েছি! কোন বংশের ছেলে হয়ে আজ পুরনো গাড়ি বেচাকেনার ব্যবসা করছি!
ওদের মুখে কিছু শুনলে না আর? ব্যবসাটা গেল কেন?
হ্যাঁ, ওদের কজন পুরনো কর্মচারীই নাকি ওদের পথে বসিয়েছে যোগসাজস করে একত্রে চুরি করে।
শ্ৰীমন্ত, শশধর, হারাধন আর শিবানন্দ,-তাও জানি।
হ্যাঁ। ওদের ওপর দেখলাম হরেন্দ্রবাবুর ভীষণ রাগ। পারলে যেন টুটি ছিঁড়ে ফেলে।
কিরীটী হেসে বললে, স্বাভাবিক।
০৯. এবার কি কর্তব্য বলুন
এবার কি কর্তব্য বলুন?
কথাটা বলে বিকাশ সেন প্রত্যাশাপূর্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
কটা দিন অপেক্ষা করতে হবে।
অপেক্ষা করতে হবে! কেন?
প্রশ্নটা করে বিকাশ সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
কার হত্যাকারী এখন তার চতুর্থ শিকারটিকে খতম করার প্ল্যান করছে-কী ভাবে এবার নীল রুমাল হাতে আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটবে–
কিন্তু–
ভয় নেই বিকাশ, এবারে অত সহজে তাকে কাজ হাসিল করতে দেওয়া হবে না।
.
সত্যি-সত্যিই দেখা গেল কিরীটী যেন নীল রুমালের দ্বারা হত্যাকাণ্ডগুলির ব্যাপারে একেবারে হাত ধুয়ে বসে আছে। ও যেন ভুলেই গেছে ব্যাপারটা।
দিন দুই পরে আবার সে দুদিনের জন্য ট্রাঙ্ককল পেয়ে দিল্লী থেকে ঘুরে এল।
আরও দিন দুই পরে।
গত সন্ধ্যা থেকেই অসময়ে আকাশে মেঘ জমে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল, ফলে শীতটাও যেন হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
কিরীটী গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে আরাম করে বিছানার ওপর বসে বসেই গরম গরম কফি পান করছিল।
এমন সময় জংলী এসে ঘর ঢুকল, বাবুজী! কি রে? বিকাশবাবু!
কিরীটী আর মুহূর্ত দেরি করে না। সঙ্গে সঙ্গে কফি শেষ করে কম্বলটা গা থেকে ফেলে উঠে দাঁড়াল। পাশে খাটের বাজু থেকে গরম ড্রেসিং গাউনটা টেনে গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে সোজা এসে বসবার ঘরে ঢুকল।
কি খবর বিকাশ-সকাল বেলতেই—
যা হবার তা হয়ে গেছে মিস্টার রায়। হতাশার সুরে বলে উঠল বিকাশ সেন।
সত্যি!
হ্যাঁ, নীল রুমাল আবার ফাঁস লাগিয়েছে–
কোথায়?
বালিগঞ্জে বোস অ্যান্ড কোং জুয়েলারি শপের প্রোপ্রাইটার—
কে, শিবানন্দ?
হ্যাঁ, শিবানন্দ বসু। বিকাশ বলে।
আশ্চর্য! ভাবতে পারিনি, সে এত তাড়াতাড়ি আবার নীল রুমাল হাতে নিয়ে আবির্ভূত হবে। এবারে আমার ক্যালকুলেশনটা দেখছি ভুল হয়ে গেল।