সুব্রত হঠাৎ উঠে পড়ে বলে, এবারে তাহলে উঠি রে—
কিরীটী বলে, মাথা খারাপ নাকি!
কৃষ্ণা বলে, আরে, তোমার বিছানা আমি করে রেখেছি।
০৮. সুব্রত হাসতে হাসতে বলে
সুব্রত হাসতে হাসতে বলে, একেই বলে সুগৃহিণী!
কৃষ্ণা হাসতে হাসতে প্রত্যুত্তর দেয়, তুমি কি বুঝবে গৃহিণীর স্বাদ-চিরটা কাল তো ব্রহ্মচর্য আশ্রমেরই পাণ্ডাগিরি করলে।
সুব্রত সখেদে বলে ওঠে, হায় ব্রুটাস, তুমিও-না, একটা ব্যবস্থা এবারে করতে হয় দেখছি—
কৃষ্ণা উৎসাহিত হয়ে উঠে বলে, সত্যি বলছ! কুন্তলাকে তাহলে সুসংবাদটা–
তিষ্ট—তিষ্ট দেবী, অত ব্যাকুল হয়ো না। সুব্রত বলে, আগে কৌশলে না হয় তার মতামতটা জেনে নাও।
সে আর জানতে হবে না, কৃষ্ণা বলে, হুঁবলে পাগলা খাবি, না আঁচাব কোথায়!
না দেবী কৃষ্ণা, সে ভদ্রমহিলাটিকে তাহলে এখনও সম্যক চিনতে পারনি।
তাই বুঝি! আচ্ছা দেখি–
কিরীটী বাধা দেয়, কেন বাজে সময় নষ্ট করছ কৃষ্ণা, ও মহাপাষণ্ড, ওর মুক্তি নেই।
সুব্রত হো হো করে হেসে ওঠে, দেখছ। কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, তোমার স্বামীরত্নটি আমাকে কেমন চিনেছে! কিন্তু রাত কত হল?
সকলেই দেওয়ালের গায়ে বসানো সুদৃশ্য ইলেকট্রিক ওয়াল-ক্লকটির দিকে একসঙ্গে দৃষ্টিপাত করল।
রাত এগারোটা বেজে দশ মিনিট।
সুব্রত বললে, না, এমন কিছু রাত হয়নি।
কৃষ্ণা হেসে বলে, কফি চাই তো?
সুব্রত বলে, এই জন্যই তো তোমাকে আমার এত পছন্দ–
খুব হয়েছে। বসো আনছি।
কেন, জংলী—
জংলী! তার এখন মধ্যরাত্রি।
বলতে বলতে কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
সুব্রত তার নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে।
কৃষ্ণাও এতক্ষণে হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত প্রায় পৌনে একটা।
শীতের রাত্রি, বাইরে যেন বরফ ঝরছে। ঠাণ্ডাও পড়েছে প্রচণ্ড। কিরীটী ঘুমোয়নি। সোফা-কাম বেডটার ওপর পিঠের তলায় একটা ডানলোপিলোর বলিশ দিয়ে মুখে পাইপ গুজে আধ-শোয়া আধ-বসা অবস্থায় রয়েছে। চোখ দুটি বোজা।
ব্যাপারটা মোটামুটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কিরীটীর কাছে।
দীর্ঘদিনের স্বর্ণব্যবসায়ী সরকার ব্রাদার্সের অতবড় নামকরা প্রতিষ্ঠানের ইমারতের তলায় কতকগুলো দুষ্ট ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল এবং পুরাতন মালিকদের মৃত্যুর পর নতুন সব অনভিজ্ঞ তরুণ মালিকদের হাতে যখন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব এসে পড়ল, সেই সুবর্ণ সুযোগটির সদ্ব্যবহার করতে দুষ্টু হঁদুরের দল এতটুকু দেরি করেনি।
কৌশলে ওদের অনভিজ্ঞতার সুযোগে প্রতিষ্ঠানটাকে ক্রমশ একটু একটু করে শোষণে শোষণে ঝাঁজরা করে ফেলেছে।
নদীর এক পাড়ে ভেঙেছে, অন্য পাড় গড়ে উঠেছে।
হীরেন সরকাররা তিন ভাই সর্বস্বান্ত হয়েছে, আর অন্য দিকে শশধর, শ্রীমন্ত, হারাধন ও শ্রীমান শিবানাথ নিভৃতে ওই বুদ্ধুদের চোখের আড়ালে আখেরটাই নিজের নিজের কেবল গুছিয়ে নেয়নি, এক-একজন শাঁসালো হয়ে উঠেছে।
তারপর একদিন অকস্মাৎ ভ্রাতৃত্রয়ের যখন চেতনা হল, তখন ওই চার মূর্তিকে ধরাছোঁয়ার আর উপায় নেই। প্রমাণ নেই—কোন প্রমাণ নেই!
অতএব যা হবার তাই হল, অতদিনকার অত বড় প্রাতিষ্ঠানটা পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হল।
ওর সঙ্গে নাটকের প্রথম অঙ্কের উপর হল যবনিকাপাত।
তারপর বেশ কিছুদিন পরে শুরু হল নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক। আবার যবনিকা উত্তোলিত হল রঙ্গমঞ্চের।
শ্ৰীমন্ত, শশধর, হারাধন, শিবানন্দ-যে যার মত করে জুয়েলারি শপ খুলে ব্যবসা শুরু করে দিল, সরকার প্রতিষ্ঠানের অন্ধকার সুড়ঙ্গ-পথে অর্জিত মূলধন নিয়ে। দিনে দিনে সকলেরই ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হাস্যে তাদের প্রতি কৃপাবৃষ্টি করতে লাগলেন। কিন্তু চার মূর্তি তখনও কল্পনাও করতে পারেনি, তাদের ভাগ্যাকাশে মেঘের সঞ্চার শুরু হয়েছে।
মেঘ ক্রমশ ঘন হতে ঘনতর হতে থাকে।
তারপরই অতর্কিতে এল বজ্রঘাত—সেই মেঘের বুক থেকে।
শ্ৰীমন্তকে তার মূল্য শোধ করতে হল। পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হল। নম্বর এক।
তারপরই বজ্ৰ নামল হারাধনের মাথায়, পাপের প্রায়শ্চিত্ত তারও হল। নম্বর দুই।
দুজনের প্রায়শ্চিত্ত দিবসের মধ্যে মাত্ৰকুড়ি দিবসের ব্যবধান। ঠিক কুড়িদিন পরে আবার বজ্র নেমে এল। এবারে শশধর—নম্বর তিন।
কি চমৎকার অঙ্কশাস্ত্রানুযায়ী বিচার!
কোথাও কোন ত্রুটি বা ভুলচুক নেই। একটি একটি করে বোড়ের চাল।
এবারে মধ্যে আর দিন তেরো-চোদ্দ বাকি। পূর্ব-পরিকল্পনানুযায়ী যদি চলতে থাকে তাহলে চতুর্থ—অর্থাৎ চারে বেদ-শ্রীমান শিবানন্দ।
আর তাহলেই দ্বিতীয় অঙ্কের উপরে যবনিকাপাত।
ঘটনাচক্রে তার দৃষ্টিতে যদি ওই অদ্ভুত বিজ্ঞাপনটা না পড়ত, তাহলে হয়ত নাটক দ্বিতীয় অঙ্কেই নিঃশব্দে শেষ হয়ে যেত।
প্রেক্ষাগৃহে অন্ধকার নেমে আসত। আর হয়ত কোনদিনই আলো জ্বলত না।
কিরীটী কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আপন মনেই মৃদু হাসে।
কিন্তু ওই নাটকের সঙ্গে সঙ্গে নেপথ্যে মঞ্চের গ্রীনরুমে আরও একটি যে নাটক সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রধান অভিনেতাটি কে?
নেপথ্য থেকে কার অদৃশ্য কালো হাত একের পর এক নীল রুমালের ফাস গলায় পরাচ্ছে? নটশিরোমণি সেই ব্যক্তি সন্দেহ নেই।
কি গো, শোবে না?
কিরীটীর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে যায় কৃষ্ণার ডাকে।
কে? ও, কৃষ্ণা।
শুতে যাবে না? রাত যে শেষ হতে চলল?
কটা রাত?
রাত আড়াইটে।
হ্যাঁ, চল।
কিরীটী শয়নকক্ষে প্রবেশ করে শয্যায় আশ্রয় নিল।