কিরীটী নিঃশব্দে শুনতে থাকে।
বাইরে আসন্ন সন্ধ্যার ধূসরতা নামে। সেই সঙ্গে শহর কলকাতার চাপ-চাপ ধোঁয়া।
সুব্রত বলতে লাগল, ছোটকর্তার মৃত্যুর পর তিন ভাই দোকানে বসতে শুরু করল। তবে ওই নামেই—সব ভরসা কর্মচারীদের ওপরেই। কেউ কোন কাজ জানো না। ওরা যা করে, যা বোঝায়—তাই ওরা বোঝে।
মাস আষ্টেক বাদে এক খরিদ্দার এল-ভদ্রলোক তো মহা খাপ্পা–
কেন?
যে গহনা তিনি করে নিয়ে গিয়েছেন, তার বোল আনার মধ্যে বারো আনাই নাকি খাদ। পরীক্ষা করে দেখা গেল কথাটা মিথ্যা নয়, সত্যিই তাই। ওরা আর কি করে, খেসারত দিল মোটা টাকার।
Interesting!
কেবল ওই খরিদ্দারটিই নয়—বিরাট ঢালাও কারবার, মাস দুয়েকের মধ্যে আরও বিশজন খরিদ্দার ওই একই কমপ্লেন নিয়ে এল। সোনায়ই যে কেবল খাদ তাই নয়, জড়োয়া গয়নার মধ্যে যে সব জুয়েলস দিয়েছে তাও মেকী।
তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসল, এ কি ব্যাপার! কিন্তু তখন যা হবার হয়ে গেছে, তলে তলে দোকান ফাঁক। সোনা যত স্টকে ছিল এবং যত রেয়ার জুয়েলস্ ছিল, সব উধাও। ঝাঝরা হয়ে গেছে দোকানটা। সবচাইতে পুরনো চারজন কর্মচারী ছিল—তাদেরও তারা ডাকল, এবং কর্মচারী চারজন কারা জানিস?
জানি শশধর, শ্ৰীমন্ত আর হারাধন নিশ্চয়ই। কিরীটী বললে।
তুই জানলি কি করে?
জানি। কিন্তু চতুর্থ ব্যক্তির নামটি কি শিবানন্দ বসু?
তুই জানলি কি করে?
জানি। তারপর একটু থেমে বললে, তাহলে দেখছি, আমার অনুমান ভুল নয়। কিরীটীর চোখের মণি দুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
কৃষ্ণা বললে, কেমন করে ওদের নাম তুমি জানলে গো? শশধর শ্রীমন্ত আর হারাধন না হয়—
বিজ্ঞাপনের কবিতাটা তোমরা ভুলে গেলে কৃষ্ণা! তাছাড়া শিবানন্দ যে এসে ছিল নিজেই।
তবে? কৃষ্ণা শুধায়।
কি তবে?
তাকেও মরতে হবে নাকি?
অঙ্ক অনুযায়ী তাই তো হওয়া উচিত। কবিতার মিলের জন্যই। যাক, ধোঁয়াটে ব্যাপারটা পরিষ্কার এখন বোঝা যাচ্ছে। খুব জটিল নয়।
হত্যাকারীকে ধরতে পেরেছ? কৃষ্ণা শুধায়।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, একেবারে যে পারছি না তা নয়। তবে উদ্দেশ্যটা-হত্যার উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আর মোটিভ যখন জানা গেছে, বাকি রহস্যটুকুও উদ্ঘাটিত করতে আর বেশি বেগ পেতে হবে না। তুই বস্ সুব্রত, স্নান করে জামাকাপড়টা বদলে আসি।
কৃষ্ণা আর সুব্রত বসে বসে গল্প করে।
কিরীটী ভেতরে চলে যায়।
আধ ঘণ্টা পরে কিরীটী ফিরে এল। পরনে তার গরম পায়জামা ও পাঞ্জাবি, গায়ে একটা সাদা শাল।
সুব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলে, উত্তিষ্ঠ বৎস!
এখন কোথায় আবার বেরুবি?
কোথায় মানে? তোর সেই পরিচিত পঙ্গু ভদ্রলোক হীরেন সরকারের ওখানে!
এখুনি?
আজ এবং ইমিডিয়াটলি। চল্ ওঠ। বেশি রাত হয়নি, মাত্র আটটা-শীতের রাত এমন কিছু নয়।
সুব্রত জানে কিরীটীকে থামানো যাবে না। ও যখন যাবে বলেছে, তখন যাবেই। কাজেই সে উঠে দাঁড়াল।
এই রাত্রে না গিয়ে কাল সকালে গেলেই হত।
না, চ। হীরেনের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।
কখন ফিরবে? কৃষ্ণা শুধায়।
বৌবাজার থেকে ফিরতে আর কতক্ষণ লাগবে! কিরীটী বলে।
সুব্রত বলে, সে তো বৌবাজারে থাকে না। সে এজমালি পৈতৃক বাড়ি তো কবেই দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে সরকারদের!
তবে? ভদ্রলোক এখন থাকেন কোথায়?
ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছে হীরেন অন্য একটা বাড়িতে থাকে।
তাই নাকি? তবে তো সে কাছেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তো তাহলে ফিরতে পারব। নে, চল্।
ওরা দুজনে বের হয়ে গেল।
০৭. ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি
ল্যান্সডাউন মার্কেটের কাছাকাছি-বাঁয়ে একটা রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে ঢুকে একটা গলির মধ্যে দোতলা একটা বাড়ি।
নিচের ঘরে আলো জ্বলছিল। কলিংবেল টিপতেই একটু পরে ঘরের দরজাটা খুলে গেল, কে?
ওরা দুজনে দরজার গোড়াতেই তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের সামনেই দাঁড়িয়ে একটি তেইশ-চব্বিশ বছরের তরুণী। পাতলা দোহারা চেহারা। পরনে একটা সিল্কের শাড়ি। চোখ-মুখ খুব সুশ্রী না হলেও উচ্ছল যৌবনরসে ও প্রসাধনে সুন্দরই দেখাচ্ছিল তরুণীকে। দুহাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।
কাকে চান?
সুব্রতই কথা বললে, হীরেন বাড়ি আছে?
আছেন তরুণী বললে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তখন তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
সুব্রত বললে, বলুন গিয়ে তাকে, সুব্রত এসেছে—সঙ্গে কিরীটী।
নিচের ঘরে ওদের বসিয়ে তরুণী ওপরে চলে গেল এবং একটু পরেই ফিরে এসে ওদের বললে, কিন্তু এখন তো দেখা হবে না।
হবে না? কেন?
তিনি ঘুমোচ্ছেন।
ঘুমোচ্ছে! এত তাড়াতাড়ি? সুব্রতই আবার প্রশ্ন করে।
রোজ এই সময়টা ঘুমের ওষুধ খান রাত্রে ঘুম হয় না বলে। ইঞ্জেকশান দেবার পর ঘুমোচ্ছেন।
ওঃ। তাহলে আর কি হবে! কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে সুব্রত।
কিরীটী বললে, হুঁ। চল, ফেরা যাক।
আচ্ছা, নমস্কার। আসি।
তরুণীও প্রতিনমস্কার জানালো দুটি হাত তুলে, নমস্কার।
ফিরে এসে ওরা গাড়িতে উঠে বসল।
কিধার জায়গা সাব? হীরা সিং শুধায়।
একবার শ্যামবাজার চল হীরা সিং-নাট্যমঞ্চ থিয়েটারে।
হীরা সিং গাড়ি ছেড়ে দিল।
সুব্রত একটু যেন বিস্মিত হয়েই বলে, আজ তো বুধবার, থিয়েটার নেই!
জানি। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী বলে।
তবে?
সজনীবাবু নিশ্চয়ই আছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করব।
সজনী গুপ্ত নামকরা একজন নাট্যকার ও নাট্য-পরিচালক এবং দীর্ঘদিন ধরে নাট্যশালার সঙ্গে জড়িত।