সেখানে মন্ত্রী মশাইয়ের বাড়িতেই তার সঙ্গে দেখা হল কিরীটীর। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী মশাই রামস্বামী বললেন, ব্যাপারটা যেমন বিস্ময়ের, তেমনি অতীব রহস্যজনক মিস্টার রায়!
খুলে বলুন।
দপ্তরের এক বিশেষ secret document-যার মধ্যে ভারতের বর্ডারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার details ছিল, সেটা অফিস-ঘরের আয়রন সেফ থেকে খোয়া গেছে।
শেষ কবে documentটা দেখেছিলেন?
তা দিন পনেরো আগে।
চুরি গেছে যে জানতে পারলেন কবে?
দিন সাতেক আগে। প্রধান মন্ত্রী documentটা দেখতে চাইলে খোঁজ করতেই ব্যাপারটা জানা গেল।
সিন্দুকের চাবি কার কাছে থাকে?
Of course সর্বদা আমারই জিম্মায়।
তার মানে, সেটা আপনি ছাড়া আর কারও খোলবার উপায় ছিল না?
নিশ্চয়ই না।
কে কে জানত আপনার অফিসের documentটা সম্পর্কে?
আমার personal secretary মিস্টার প্রতাপ সিং ছাড়া আর কেউ জানত না।
তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?
করেছি। সে কিছু বলতে পারছে না।
ভদ্রলোক নিশ্চয়ই খুব বিশ্বাসী?
নিঃসন্দেহে।
কোথায় যেতে পারে বলে দলিলটা আপনার মনে হয়—মানে documentটা? Any idea?
খবর পেয়েছি সেটা পাকিস্তানে চালান হয়ে গেছে।
ক্ষতির সম্ভাবনা আছে তাতে নিশ্চয়ই?
ক্ষতি! তা কিছুটা তো আছে বটেই। কিন্তু তার চাইতেও বেশি যেটা চিন্তার কারণ হয়েছে, এভাবে যদি secret documents সেফ থেকে পাচার হয়ে যেতে থাকে—
সমূহ বিপদ!
বলুন, তাই নয় কি? প্রধান মন্ত্রী তো বিশেষ খাপ্পা হয়েছেন—
স্বাভাবিক।
একটা কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে, যেমন করে হোক!
আপনার Secret Intelligence Branch-এর officer-রা করতে পারলেন না?
তারা ওইটুকু সংবাদই সংগ্রহ করতে পেরেছে। সেগুলি পাকিস্তানে চালান হয়ে গেছে। I want your help, মিস্টার রায়।
দেখি কি করতে পারি।
মন্ত্রী মশাইয়ের ওখান থেকে বিদায় নিয়ে কিরীটী বেদপাল পাবলিশিং কোম্পানির খোঁজে দরিয়াগঞ্জে গেল।
কিন্তু যা সে মনে মনে আশঙ্কা করেছিল—ওই নামে কোন পাবলিশিং কোম্পানির কোন অস্তিত্বই নেই।
০৬. দিন চারেক বাদে কিরীটী
দিন চারেক বাদে কিরীটী কলকাতায় ফিরে এল।
আগেই দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককল করে দিয়েছিল কিরীটী, গাড়ি এয়ারপোর্টে পাঠাবার জন্য।
বাড়ি পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে ঘরে ঢুকতেই দেখে সুব্রত বসে আছে।
সুব্রত জানত কেন কিরীটী দিল্লী গেছে। সে বললে, কি হল, দিল্লীর ব্যাপারের কোন হদিস করতে পারলি?
ব্যাপারটা জটিল। সময় শেষ, তবে মনে হচ্ছে—
কি?
কিরীটী সোফার ওপরে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, আমাদের বিকাশ সেনকেও কথা দিয়েছি, নচেৎ কটা দিন ওখানে আরও থেকে প্রাথমিক ব্যাপারটা শেষ করে আসতাম।
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, তার হাতে ছোট একটা ট্রের উপর ধূমায়িত দু কাপ কফি নিয়ে।
শরীর ভাল আছে তো? কৃষ্ণা সহাস্যে শুধায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে।
কফির কাপটা হাতে নিতে নিতে কিরীটী বললে, ভাল। নে সুব্রত।
সুব্রতও একটা কাপ তুলে নিল। কৃষ্ণা পাশেই বসল কিরীটীর।
শীতের ছোট বেলা বাইরে তখন প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। পড়ন্ত আলোর সঙ্গে একটা আবছায়া ঘনাচ্ছে যেন।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বললে, এখানে বেশ শীত পড়েছে দেখছি।
সুব্রত বললে, হ্যাঁ, পরশু থেকে। দিল্লীতে শীত কেমন পেলি?
রাজধানীর ব্যাপার তো, কিরীটী হাসতে হাসতে বললে, হাড়-কাপানো! তার পর তোর হীরেন সরকারের সঙ্গে দেখা করেছিলি সুব্রত?
গিয়েছিলাম।
গিয়েছিলি? কবে আসছে?
তার পক্ষ আসা সম্ভব নয়।
কেন? আসতে চায় না বুঝি?
না, বেচারী মাস আষ্টেক ধরে একেবারে শয্যাশায়ী।
শয্যাশায়ী! কি হয়েছে কি?
লোয়ার মটোর প্যারালিসিসে পা দুটো পঙ্গু, শয্যা থেকে উঠতেই পারে না। রোগা। হয়ে গেছে।
তাই নাকি!
তাই দেখলাম। বললে, তুই ডেকেছিস, আলাপ করতে চাস-এ যে তার কি সৌভাগ্য! কিন্তু আসতে পারবে না–
কিরীটী বললে, তাতে আর কি হয়েছে, আমরাই না হয় যাব আজ।
আজই যাবি?
হ্যাঁ। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করা একটিবার বিশেষ দরকার। তা ভদ্রলোকের অবস্থা কেমন দেখলি? দোকান উঠে যাবার পর–
দোকানটা ওদের তিনজনের ছিল—মানে জ্যাঠতুত, খুড়তুত তিন ভায়ের। ওদের বাবা কাকা জ্যাঠারা অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।
তারপর?
ওরা তিন ভাই-ই দোকানটা দেখাশোনা করছিল-চলছিলও বেশ। হঠাৎ একদিন আবিষ্কৃত হল, ভেতরে ভেতরে শনির দৃষ্টি পড়েছে দোকানটার ওপরে।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। যেদিন ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হল, অর্থাৎ ওরা জানতে পারল, দেখলে ওদের কারিগরেরাই ওদের পথে বসিয়েছে।
কারিগরেরা পথে বসিয়েছে কি রকম?
আসলে ওদের তিনজনের একজনও কাজকর্ম কিছু জানত না। ধনী গৃহের ছেলে,–সোনার চামচ মুখে দিয়ে সব জন্মেছিল। কখনও দোকানের কাজকর্ম যেমন কিছু শেখবার চেষ্টা করেনি, তেমন কাজকর্মও বুঝত না। ওদের ছোট কাকাই সব দেখাশোনা করছিল, তার আর দু ভাইয়ের মৃত্যুর পর। ওরা মধ্যে মধ্যে সেজেগুজে দোকানে আসত। আর মোটা মাসোহারা নিত। তিন ভাই দামী দামী গাড়িতে চড়ত, বাবুয়ানী করত। একজনের ছিল রেস খেলার বাতিক, একজনের দেশভ্রমণের বাতিক, আর হীরেনের। ছিল থিয়েটারের বাতিক–
থিয়েটার।
হ্যাঁ। ভাল চেহারা না থাকলেও অভিনয় সে ভালই করত। নামও করেছিল। একটা নামকরা পাবলিক রঙ্গমঞ্চে অ্যামেচার অভিনেতা হিসাবে অভিনয় করত। হীরেনের বাবা আগেই মারা গিয়েছিল। ছোট ভাই কর্তাদের মধ্যে। মেজ কর্তার সন্তানাদি ছিল না। বড়কর্তার দুই ছেলে—হরেন্দ্র আর নীরেন্দ্র।