ওঃ, সত্যিই তো, আমারই ভুল হয়ে গিয়েছে। সীতা, দাও তো মা দক্ষিণের জানালাটা খুলে। এ বাড়িতে এত বেশী হাওয়া যে বিরক্ত ধরে যায়, তাই বেশীর ভাগ সময় জানালাগুলো এঁটে রাখি—
না, থাক না, তেমন কিছু বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। কিরীটী প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করে। সীতা কিন্তু ততক্ষণে মায়ের আদেশে এগিয়ে গিয়ে ঘরের একটা জানালা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে বাইরের সমুদ্রবক্ষ থেকে একঝুলক ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে হু-হু করে বয়ে এল সমুদ্রের নোনা স্বাদ নিয়ে। সেই সঙ্গে এল অদূরাগত সমুদ্রের শব্দকল্লোল। বাইরের দূরন্ত খ্যাপা সমুদ্রের স্পর্শ যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যেকার পীড়িত বন্ধ আবহাওয়াটাকে মুহূর্তে এসে একটা মুক্তির স্নিগ্ধ পরশ দিয়ে গেল।
দেখলাম জানালাটা খুলে সীতা আর ফিরে এল না, খোলা জানালার গরাদ ধরেই দাঁড়িয়ে রইল ঘরের দিকে পিছন ফিরে। বাইরের রহস্যময় সমুদ্রের মত সীতার দেহটাও যেন একটা রহস্যে পরিণত হয়েছে।
এখানে বুঝি বেড়াতে এসেছেন মিঃ রায়? হিরন্ময়ী আবার প্রশ্ন করলেন কিরীটীকেই লক্ষ্য করে।
হ্যাঁ। সী-সাইডটা এখানকার ভারী চমৎকার!
শতদলের সঙ্গে আপনার আগেই বুঝি আলাপ ছিল?
না। আজই সকালে সবে আলাপ হয়েছে।
ওঃ, সবে আজই আলাপ হয়েছে?
হ্যাঁ।
আপনারা আসবেন সে কি জানত না? আবার প্রশ্ন করলেন হিরন্ময়ী দেবী!
না। ভেবেছিলাম একটা surprise visit দেব।
সহসা এমন সময় বাইরের অন্ধকার ভেদ করে সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে ক্রুদ্ধ একটা জন্তুর চিৎকার কানে ভেসে এল। বাইরের অন্ধকার যেন সহসা একটা আর্তনাদ করে উঠলো। চমকে হিরন্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকাতেই দ্বিতীয়বার আবার সেই ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল, এবারে বুঝলাম কোনো বড় জাতীয় বিলেতী কুকুরের ডাক সেটা।
হঠাৎ সীতা ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুতপদে কক্ষ হতে বের হয়ে গেল।
কুকুরটার গম্ভীর ডাকটা বাইরের অন্ধকারকে যেন ফালি ফালি করে দিচ্ছে।
০৩. হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন
হিরন্ময়ী দেবীই প্রথমে কথা বললেন, সীতার কুকুর টাইগারটা অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন?
কিরীটী ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। হরবিলাসবাবুর দিকে তাকিয়ে বললে, আজ এবার তাহলে আমরা উঠি মিঃ ঘোষ!
উঠবেন? এখনি উঠবেন? হিরন্ময়ী দেবী প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, রাত হয়ে গেল। আবার কাল-পরশু আসব। শতদলবাবুকে তাহলে বলবেন আমরা এসেছিলাম।
বলব, দেখা হলে বলব। হরবিলাস জবাব দিলেন।
কেন, আপনাদের সঙ্গে কি দেখা-সাক্ষাৎ হয় না? এক বাড়িতেই তো—
এক বাড়ি হলে কি হয়? বাইরের মহলের সঙ্গে ভিতরের মহলের কোন যোগাযোগ নেই, সম্পূর্ণ পৃথক। আমরা থাকি বাইরের মহলে, তাই বড় একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। জবাব দিলেন হিরন্ময়ী দেবী।
হরবিলাসই আমাদের দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেলেন। এবং কিরীটীই তাঁকে অনুরোধ জানাল আর বেশী দূর না আসবার জন্যে।
আপনাকে আর গেট পর্যন্ত কষ্ট করে আসতে হবে না, মিঃ ঘোষ। এবারে আমরা নিজেরাই যেতে পারব।
না না, তাতে কি, চলুন না গেট পর্যন্ত।
না, আপনি যান।
হরবিলাস ফিরে গেলেন। পাশাপাশি আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম।
গেটের কাছাকাছি প্রায় এসেছি, হঠাৎ একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর-র শব্দ শুনে দুজনেই থমকে দাঁড়াই।
শব্দটা লক্ষ্য করে সামনের অন্ধকারে গেটের ঠিক পাশেই চামেলী-ঝাড়টার দিকে তাকিয়ে চোখের দৃষ্টি আমার পাথরের মতই স্থির হয়ে গেল। অন্ধকারে দুটো আগুনের ভাঁটা যেন ক্রুদ্ধ জিঘাংসায় ধকধক জ্বলছে। অশরীরী কোন প্রেত যেন হিংস্রলোলুপ হয়ে আমাদের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে।
গোঁ-গর-র একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন।
আঃ Tiger, stop! Stop! চাপা মেয়েলী কণ্ঠের একটা নির্দেশ শোনা গেল।
সীতার গলা।
অন্ধকারে চামেলী-ঝোপটার নিচু থেকে ছায়ার মত নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে এল সীতা এবং তার পাশে এগিয়ে এল প্রকাণ্ড একটা কালো আলসেসিয়ান কুকুর তো নয় যেন একটা বাঘ!
কিন্তু আশ্চর্য, কুকুরটা তার মনিবের নির্দেশে তখন একেবারে চুপ করে গিয়েছে—শান্ত, স্থির!
চলে যাচ্ছেন বুঝি? সীতা আবার প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। আপনার ঐ টাইগারের ডাকই বুঝি একটু আগে শোনা গিয়েছিল! প্রশ্ন করল কিরীটী।
হ্যাঁ। অচেনা কারো সাড়া পেলে টাইগারটা যেন একেবারে ক্ষেপে ওঠে। বোধ হয় কোনমতে আপনাদের সাড়া পেয়েছিল। হাসতে হাসতে জবাব দেয়।
কিন্তু একটু দেরিতে পেয়েছিল বোধ হয় মিস ঘোষ! প্রত্যুত্তরে হাসতে হাসতে কিরীটী জবাব দেয়।
কিরীটীর ইঙ্গিতটা সীতা বুঝতে পারল কিনা বোঝা গেল না, কারণ জবাবে সে বললে, আর কখনো আপনাদের দেখলে ও গোলমাল করবে না। টাইগার, চিনে রাখ, এরা আমাদের বন্ধু। ভাল লোক।
কুকুরুটি আপনার কী খায় মিস ঘোষ? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
মাংস আর রুটি। জবাব দেয় সীতা।
আচ্ছা চলি, মিস ঘোষ, নমস্কার। কিরীটী হাত তুলে নমস্কার জানিয়ে এগিয়ে গেল।
চলুন, নিচু পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি কিরীটীবাবু। এ পাহাড়টার উপর বেজায় সাপের উৎপাত।
তাই নাকি? কিরীটী চলতে চলতেই বলে।
হ্যাঁ। সব একেবারে ভয়ঙ্কর বিষধর গোখরো।
সাপকে বুঝি আপনার ভয় করে না? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না, সঙ্গে টাইগার থাকলে এ জগতে কিছুকেই আমি ভয় করি না।