প্রকাণ্ড দরজা পার হয়ে আমরা সকলে বাড়ির মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।
সামনেই একটা বারান্দা এবং বারান্দা অতিক্রম করে একটা সুসজ্জিত হলঘর, সেটা পার হয়ে মাঝারি গোছের একটা আলোকিত কক্ষমধ্যে এসে আমরা প্রবেশ করলাম।
ঘরে সিলিং থেকে একটা বাতি ঝুলছে। সেই আলোয় প্রথমেই নজরে পড়ে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে একটা টেবিলের পাশে একটা ইনভ্যালিড চেয়ারের উপর বসে একজন স্থূলাঙ্গী মধ্যবয়সী মহিলা উল ও কাঁটার সাহায্যে কী যেন একটা বুনে চলেছেন অত্যন্ত ক্ষিপ্র হস্তে।
ভদ্রমহিলা আমাদের পদশব্দে মুখ তুলে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, কিন্তু হাত দুটি যেন মেশিনের মতই অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে বয়নকার্য চালিয়ে যেতে লাগল।
সিলিং থেকে ঝুলন্ত আলোর স্বল্প রশ্মি যা সেই উপবিষ্ট ভদ্রমহিলার মুখের উপরে এসে পড়েছিল তাতেই তাঁর মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পাথরের মত ভাবলেশহীন এমন মুখ ইতিপূর্বে খুব কমই যেন চোখে পড়েছে। আর তাঁর দুটি চক্ষুর স্থির দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমাদের অন্তস্তল পর্যন্ত ভেদ করে চলে যাচ্ছে। আমাদের চোখে-মুখে এসে যেন বিধছে। মুখের একটি রেখারও এতটুকু পরিবর্তন দেখা গেল না।
আড়চোখে একবার কিরীটীর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না, কিন্তু কিরীটীর চোখে-মুখে কোন কিছুরই সন্ধান পেলাম না।
হিরণ দেখ, এরা আজ আমাদের গৃহে সান্ধ্য-অতিথি। সুব্রতবাবু, কিরীটীবাবু—এই আমার স্ত্রী হিরন্ময়ী—হরবিলাস শেষের কথাগুলো আমাদের উভয়ের দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ করলেন।
আসুন। বসুন। কী সৌভাগ্য আমাদের! হিরন্ময়ী আমাদের নিষ্প্রাণ কণ্ঠে যেন আহ্বান জানালেন। আমরা উভয়ে পাশাপাশি দুটো চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
আশ্চর্য একটা জিনিস লক্ষ্য করছিলাম, ঘরের সব কটি জানলাই বন্ধ। একটা চাপা গুমোট ভাব যেন সমস্ত ঘরটার মধ্যে থমথম করছে। বুকটা কেমন চেপে ধরছে।
সামনে টেবিলটার ওপরে সূক্ষ্ম সূচের এমব্রয়ডারি করা একটি টেবিলক্লথ বিছানো, তার উপরে সজ্জিত চায়ের সাজসরঞ্জাম। ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র সামান্য যা আছে তাও এক পরিপাটিভাবে যেখানকার যেটি ঠিক হওয়া উচিত রুচিসম্মতভাবে সাজানো। তথাপি মনে হচ্ছিল, সব কিছুর মধ্যে একটা সযত্ন সুচারু পরিচ্ছন্নতা থাকলেও কিসের যেন একটা অভাব আছে। সবই আছে অথচ কী যেন নেই! কোথায় যেন ছন্দপতন হয়েছে।
সত্যিই সৌভাগ্য আমাদের কিরীটীবাবু, আপনাকে আজ আমার ঘরে অতিথি পেয়ে। হিরন্ময়ী দেবী কিরীটীকে লক্ষ্য করেই কথাটা উচ্চারণ করলেন, আপনাকে ইতিপূর্বে আমার দেখবার সৌভাগ্য না হলেও আপনার নাম আমি শুনেছি।
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটা হাসির আভাস যেন বঙ্কিম রেখায় জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়।
তা ছাড়া, হিরন্ময়ী দেবী আবার বলতে শুরু করেন, আজ দেড় বৎসরের মধ্যে এমন জায়গায় পড়ে আছি যে কারও সঙ্গে বড় একটা দেখাই হয় না, তাই কেউ এলে মনে হয় যেন বন্ধ এই ঘরটার মধ্যে একটা খোলা হাওয়ার ঝুলক বয়ে গেল। উঃ, এই ঘরটি এবং পাশের ছোট একটা ঘর—এরই এই সঙ্কীর্ণতার মধ্যে এই দীর্ঘ দেড় বছরের রাত্রি দিন দুপুরগুলো কীভাবে যে কাটাচ্ছি তা আমি জানি। একটা ক্লান্ত অবসন্নতা যেন হিরন্ময়ীর কণ্ঠস্বরে মূর্ত হয়ে ওঠে। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন তাঁর বুকখানা কাঁপিয়ে বের হয়ে আসে।
হরবিলাস কন্যাকে তাড়া দিলেন, কই রে সীতা, এদের চা দে!
সীতা ইতিমধ্যে চায়ের কাপগুলো সাজিয়ে দুধ দিয়ে চা ঢালতে শুরু করেছিল। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের কে কয় চামচ করে চিনি নেন চায়ে?
আমি বললাম, আমাকে ছোট চামচের এক চামচ দেবেন, আর ওকে দেড় চামচ দেবেন।
সীতা আমাদের দিকে চা ও প্লেটে কিছু কেক এগিয়ে দিল।
চা-টা নিতে নিতে বললাম, ও প্লেটটা সরিয়ে রাখুন সীতা দেবী-বিকেলে হোটেল থেকে বের হবার পূর্বেই একপেট খেয়ে এসেছি।
তা হোক, তা হোক, একটু খেয়ে দেখুন বাজারের জিনিস নয়, আমার স্ত্রীরই নিজের হাতের তৈরী। হরবিলাস বলে উঠলেন।
কিন্তু পেটে যে একেবারে জায়গা নেই হরবিলাসবাবু! কিরীটী হাসতে হাসতে বলে।
আরে মশাই, এক পীস কেক আর খেতে পারবেন না? বললে হয়তো বলবেন লোকটা তার নিজের স্ত্রীর প্রশংসা করছে, কিন্তু তা নয়, ঊনত্রিশ বছর ঘর করছি তো, অমন রান্না মশাই কোথাও খেলাম না! আসবেন একদিন, এখানে দুপুরে আহার করবেন।
না, উনি রোগী মানুষ—কিরীটী প্রতিবাদ জানায়।
তাতেও কি উনি নিশ্চিন্ত থাকেন! ঐ invalid চেয়ারে বসে বসেই রোজ দুবেলা রান্নার যাবতীয় সব করেন।
সত্যি আশ্চর্য তো! আমি বলি, কষ্ট হয় না আপনার?
বরং এমনি করে সারাটা দিন চেয়ারের উপর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকাটাই আমার দুঃসহ লাগে। তাই যত পারি নিজেকে engaged রেখে দেহের এই অভিশাপটা ভুলে থাকবার চেষ্টা করি। তাছাড়া দেখুন, এমন জায়গায় পড়ে আছি, একটা লোকজনের মুখে পর্যন্ত দেখবার উপায় নেই। তাই তো ওকে বলি, যে ভাই এত আদর করে এখানে নিয়ে এল আমায়, সেই যখন চলে গেল আর কেন, চল অন্য কোথাও চলে যাই। দেহটা অকর্মণ্য হয়ে গিয়েছে বলে বেশী দিন এক জায়গায় থাকতেও ভাল লাগে না।
ঘরের মধ্যে অত্যন্ত গরম বোধ হচ্ছিল। শীতকাল হলেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। কিরীটীরও বোধ হয় গরম লাগছিল ঘরের মধ্যে। সে-ই বলে উঠল, ঘরটার মধ্যে বেশ গরম মনে হচ্ছে যেন।