গেট ঠেলে দুজনে ভিতরের কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করলাম। হাত-চারেক চওড়া লাল সুরকি ঢালা পথ বরাবর বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দুজনে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম।
দোতলার ও একতলার সব জানালাগুলোেই দেখছি ভিতর থেকে বন্ধ।
মাঝামাঝি রাস্তা এগিয়েছি, হঠাৎ একটা কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমকে পাশের দিকে তাকালাম। একঝাড় গোলাপগাছের সামনে হাতে একটা খুরপি নিয়ে একজন প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে।
কাকে চান?
দেখলাম লোকটা বেশ রীতিমত ঢ্যাঙা। এবং একটু কুঁজো হয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে। পরিধানে একটা ধুতি ও গায়ে একটা গরম গেঞ্জি। গেঞ্জির হাতা দুটো গোটানো এবং দুই হাতেই কাদামাটি লেগে আছে। বুঝলাম প্রৌঢ় বাগানের গোলাপ গাছগুলোর সংস্কার করছিল।
প্রৌঢ়ের মাথার চুলগুলো সবই প্রায় পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে। কপালের উপর বলিরেখাগুলো বয়সের ইঙ্গিত দিলেও দেহের মধ্যে যেন একটা বলিষ্ঠ কর্মপটুতা দেহের সমগ্র পেশীতে পেশীতে সুস্পষ্ট ও সজাগ হয়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, এককালে ভদ্রলোক শরীরে যথেষ্ট শক্তি তো ধরতেনই, এখনও অবশিষ্ট যা আছে তাও নেহাত কম নয়।
দেহের ও মুখের রঙ অনেকটা তামাটে। রৌদ্র-জলে পোড়-খাওয়া দেহ। হাতের আঙুলগুলো কী মোটা মোটা ও লম্বা!
ভদ্রলোকের প্রশ্নে এবার কিরীটী জবাব দিল, শতদলবাবু আছেন?
শতদল! সে তো এমন সময় কখনো বাড়িতে থাকে না। গোটাচারেকের সময় বের হয়ে যায়।
ফেরেন কখন?
তা রাত্রে ক্লাব থেকে ফিরতে রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটা হয়।
এখানকার ক্লাব বলতে সাগর-সৈকত হোটেলেরই নিচের একটা ঘরে নাচগান তাস দাবাখেলা ও ড্রিঙ্কের ব্যবস্থা আছে, সেটাই এখানকার ক্লাব। এখানকার স্থানীয় ভদ্রলোকেরা সেইখানেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় এসে মিলিত হন। এবং রাত দশটা পর্যন্ত আনন্দ চলে সেখানে।
আমি যতদূর জানতাম, শতদলবাবু এখানে একাই থাকেন! কিরীটী প্রৌঢ়কে আবার প্রশ্ন করে।
শতদল তো মাত্র মাসখানেক হল এসেছে। আমি আমার স্ত্রী ও আমার মেয়েকে নিয়ে এক বছরের উপরে এখানে আছি। তা ছাড়া চাকর অবিনাশ, মালী রঘুনাথ আছে।
ওঃ, তা আপনি শতদলবাবুর—
রণধীর আমার সম্পর্কে শ্যালক হত।
ওঃ, রণধীরবাবুর আপনি তাহলে ভগ্নীপতি হন?
হ্যাঁ।
চমৎকার জায়গায় বাড়িটি কিন্তু–, কতকটা যেন তোষামোদের কণ্ঠেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
আর মশাই চমৎকার জায়গা! নেহাত আটকা পড়ে গিয়েছি, নইলে এমন জায়গায় মানুষ থাকে? আধ মাইলের মধ্যে জন-মনিষ্যি পর্যন্ত একটা নেই। রাতবিরেতে ডাকাত পড়লে চেঁচিয়েও কারো সাড়া পাবার উপায় নেই।
কিরীটী হাসতে হাসতে জবাব দেয়, বাইরে থেকে যেভাবে বাড়িটা তৈরী দেখছি তাতে ডাকাত পড়লেও বিশেষ তেমন কিছু একটা সুবিধা করতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
এমন সময় সুমিষ্ট মেয়েলী গলায় আহান শোনা গেল, বাবা গো বাবা! এত করে তোমাকে ডাকছি, তা কি শুনতে পাও না? ওদিকে চা যে জড়িয়ে জল হয়ে গেল!
চেয়ে দেখি একটি উনিশ-কুড়ি বৎসরের শ্যামবর্ণ একহারা চেহারার মেয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
মেয়েটির পরিধানে চমৎকার একটি নীলাম্বরী শাড়ি, কলকাতার কলেজের মেয়েদের মত স্টাইল করে পরা, গায়ে সাদা ব্লাউজ।
মেয়েটি ততক্ষণে একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কখন আবার তুই ডাকলি আমায় সীতা! মেয়েটির বাপ জবাব দেন।
রোগা একহারা চেহারা হলে কী হয় এবং গায়ের রঙ শ্যাম হলেও অপরূপ একটা লাবণ্য যেন মেয়েটির সর্বদেহে। সর্বাপেক্ষা মেয়েটির মুখখানির যেন তুলনা হয় না—চোখে-মুখে একটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ রয়েছে।
মেয়েটির দেহের সর্বাপেক্ষা বড় সম্পদ তার পর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশ। বর্মীদের ধরনে মাথার উপরে প্যাগোডার আকারে বাঁধা। হাতে একগাছি করে কাঁচের চুড়ি।
এইটিই আমার মেয়ে সীতা। হ্যাঁ, ভাল কথা—আপনাদের নাম তো জানা হল না! আমার নাম হরবিলাস ঘোষ। হরবিলাস নিজের পরিচয় দিলেন।
পরিচয়টা দিলাম এবারে আমিই, আমার নাম সুব্রত রায়, আর ইনি হচ্ছেন কিরীটী রায়।
আবার একদফা নমস্কার প্রতি-নমস্কারের আদান-প্রদান হল।
আসুন না কিরীটীবাবু, শতদলের কাছে এসেছেন, সে যখন বাড়িতে নেই আমার আতিথেয়তাটুকু না হয় গ্রহণ করুন, এক কাপ করে চা—আপত্তি আছে নাকি কিছু? কথাগুলো বলে হরবিলাস একবার কিরীটী ও একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমি একটু ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু কিরীটী দ্বিধামাত্র না করে বললে, সানন্দে। বিশেষ করে চা যখন। কিন্তু সীতা দেবী, আপনার আপত্তি নেই তো? কথাটা শেষ করল কিরীটী সীতার মুখের দিকেই তাকিয়ে।
আপত্তি! বা রে, আপত্তি হবে কেন? আসুন না—
হ্যাঁ, চলুন। এই পাণ্ডব-বর্জিত বাড়িতে লোকের মুখ দেখবারও তো উপায় নেই। তাছাড়া আমার স্ত্রীও আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে সুখী হবেন। রোগী মানুষ, কোথাও তো বের হতে পারেন না।
রোগী! কিরীটী সবিস্ময়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, আজ দু বছর ধরে নিম্ন-অঙ্গের পক্ষাঘাতে ভুগছেন। তাঁর জনেই তো এখানে আসা আমার শ্যালকের অনুরোধে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার প্রকৃতির বুকে ঘন হয়ে এসেছে। দূরে সন্ধ্যার অষ্পষ্ট আলোয় মনে হয়, সমুদ্রের জলে কে যেন একরাশ কালো কালি ঢেলে দিয়েছে, কেবল মধ্যে মধ্যে ঢেউয়ের চূড়ায় শুভ্র ফেনাগুলো কোন ক্ষধিত করাল দানবের হিংস্র দন্তপাতির মত ঝিকিয়ে উঠছে আর তার সঙ্গে সঙ্গে চাপা ক্রদ্ধ গর্জন একটানা ছেদহীন।