ঘোষাল-সাহেব এই সময় এসে ঘরে প্রবেশ করলেন। ব্যাপার কি কিরীটীবাবু! এত জরুরী তলব কেন? ঘোষাল প্রশ্ন করেন।
এই যে আসুন ঘোষাল সাহেব। আপনার নিরালা ও সীতা-হত্যা রহস্যের মীমাংসা হয়েছে। কিরীটী আহ্বান জানাল ঘোষালকে।
সত্যি!
হ্যাঁ।
কিন্তু ইনি—ইনি কে?
বিখ্যাত স্পোর্টসম্যান আমাদের কুমারেশ সরকার।
নমস্কার। তা উনি—
ঘটনাচক্রে উনিই তো যত অনর্থের মূল! কিরীটী জবাব দেয়।
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? প্রশ্নটা করল শতদল।
হ্যাঁ। বর্তমান রহস্যের উনিই নিউক্লিয়স! ওঁকে কেন্দ্র করেই সব কিছু ঘটেছে!
তার মানে?
তার মানেটা আপনার চাইতেও কারো বেশী জানবার কথা নয় শতদলবাবু। গম্ভীর কিরীটীর কণ্ঠস্বর।
আমি!
হ্যাঁ আপনি। চমৎকার খেলা খেলেছেন শতদলবাবু কিন্তু বড়ের চালে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছেন—তাতেই কিন্তু মাত হয়ে গিয়েছেন!
আপনি—
শতদলবাবু আমি কিরীটী রায়।
মিঃ রায়! ঘোষাল সাহেব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকান কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ মিঃ ঘোষাল, উনি– আমাদের শতদল বোসই এই নাটকের প্রধান চরিত্র। সকল রহস্যের মেঘনাদ। সীতা দেবীর হত্যাকারী।
ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল।
১৯. নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম
নিরালাতেই আমরা সকলে উপস্থিত ছিলাম—আমি, হিরণ্ময়ী দেবী, হরবিলাস, কুমারেশ, রাণু, কবিতা গুহ ও ঘোষাল। এবং ঘোষাল সাহেবের অনুরোধেই কিরীটী নিরালা ও সীতার হত্যা-রহস্য সবিস্তারে বর্ণনা করল পরের দিন।
খেয়ালী শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নিজের কন্যা বনলতা অধ্যাপক শ্যামাচরণ সরকারকে তাঁর অমতে ভালবেসে অসবর্ণ বিবাহ করায় ত্যাগ করলেও কন্যাকে তিনি কোন দিনই ভুলতে পারেননি এবং যদিও কন্যার জীবিতকালে কন্যা বনলতার কোন দিন মুখদর্শন করেননি, কন্যার মৃত্যুর পর ও নিজের মৃত্যুর পূর্বে বোধ হয় পিতার মনে অনুশোচনা এসেছিল। ফলে তাঁর সত্যিকারের যে সম্পদ ছিল, কতকগুলো বহু মূল্যবান জুয়েল, সেগুলো তাঁরই হাতে অঙ্কিত প্রপিতামহের অয়েল-পেন্টিংটার ফ্রেমের মধ্যে কৌশলে ভরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেগুলো তাঁর মৃতা কন্যার একমাত্র পুত্র কুমারেশবাবুকেই দিয়ে যান উইল করে। অবশ্য শিল্পীর খেয়ালী মন তাঁর, তাই উইলটাকে একটা বিচিত্র চিঠির মত করে রেখে গিয়েছিলেন এবং তার একটি কপি নিরালার সিন্দুকে রেখে অন্য একটি কপি ডাকে কুমারেশের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এখানে অবশ্য একটা কথা উঠতে পারে, জুয়েলগুলো কুমারেশবাবুকেই যদি তাঁর দেবার ইচ্ছে ছিল—খোলাখুলিভাবেই তো একটা চিঠিতে সেকথা কুমারেশবাবুকে জানিয়ে যেতে পারতেন বা দিয়ে যেতে পারতেন। তবু, যে কেন তা না করে অমন একটা কৌতুক করে রেখে গিয়েছিলেন তা তিনিই জানতেন। তবে মনে হয়, এও তাঁর খেয়ালী মনের একটা বিচিত্র খেয়াল ভিন্ন কিছু নয়। যা হোক, রণধীর চৌধুরীর মৃত্যুর পর শতদলবাবু এখানে নিরালায় এসে ঐ চিঠির সরল মানে অনুযায়ীই সমস্ত সম্পত্তি নিজের হাতে নেন। চিঠিটার অপ্রকাশ্য সাংকেতিক অর্থটা তিনি প্রথমে ধরতে পারেননি। তারপর হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যখন সম্পত্তির ব্যাপার নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়, তখন হয়তো হিরণ্ময়ী দেবীকে শতদল ঐ চিঠিটা দেখায়। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী হিরণ্ময়ী দেবী চিঠিটা পড়ে মনে মনে সন্দেহযুক্ত হয়ে ওঠেন। এবং খুব সম্ভবত ঐ চিঠিটার কথা ভাবতে ভাবতে কোন এক মুহূর্তে চিঠির সাংকেতিক রহস্যটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। এবং তিনি কোন সময়ে হয়তো শতদলকে কিছু বলেন। এই গেল প্রথম পর্ব বা অধ্যায়। এবারে আসব আমি রহস্যের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। শতদল যে মুহূর্তে জানতে পারলে চিঠির আসল রহস্য, মনে মনে তার প্ল্যান ঠিক করে নিল। হরবিলাসের নামে বেনাম চিঠি দিয়ে ভুখনার সাহায্যে প্রথমেই কুমারেশবাবুকে এনে নিরালার বাগানের মধ্যে secluded outhouse-এ বন্দী করে ধীরে ধীরে মরফিয়ায় addict করে তুলতে লাগল ও সেই সঙ্গে অপর্যাপ্ত আহার দিয়ে দুর্বল করে ফেলতে লাগল। তার ইচ্ছা ছিল হয়তো চট করে কুমারেশকে হত্যা না করে ধীরে ধীরে তাকে morphiaর নেশা ধরিয়ে cripple করে ফেলবে এবং পরে হয়তো প্রয়োজনমত সুযোগ বুঝে একেবারে শেষ করে ফেলতেও কষ্ট পেতে হবে না। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই তার প্রথম খেলা। দ্বিতীয় খেলা শুরু হল হরবিলাস ও হিরণ্ময়ী দেবীর উপরে সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে তাঁদেরও নিজের পথ থেকে সরানো। ঘটনাচক্রে এই সময় আমি ও সুব্রত এখানে এলাম এবং এখানকার স্থানীয় সংবাদপত্রে আমার এখানে আগমনের সংবাদ পেয়ে আমাকেও এই ঘটনার মধ্যে টেনে এনে নিজেকে আরও safe করবার মতলব করলে। আমার সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও সংবাদপত্রের মারফৎ আমার চেহারা ও আমার পরিচয় শতদলের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। এবং এখানে এসে যে হোটেলে উঠেছি সেও শতদলের পূর্বাহ্নেই জানা ছিল। একটা নাটকীয় কৌতুকের মধ্যে দিয়ে নিজে যেন আচমকা কোন অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের গুলিতে আহত হয়েছে এই রকম pose নিয়ে শতদল আমার সামনে এসে আবির্ভূত হয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের পরিচয় ঘটাল। প্রথমটায় frankly বলতে গেলে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। পরে যখন তলিয়ে ভাবি, তখনই সর্বপ্রথম আমার মনে সন্দেহ জাগে। শতদলের life-এর উপরে তিন-চারবার attempt হয়েছে—একবার হোটেলের সামনে গুলি করে, একবার নিরালার পথে পাথর গড়াবার গল্প বলে, একবার শয়নঘরে ছবির তার কেটে, একবার নিজের ঘরে রিভলবার ছুড়ে আলোর চিমনি ভেঙ্গে—সে আমার কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছে ব্যাপারটা। প্রতিবারই ব্যাপারগুলো আমি প্রথমে genuine ভেবেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা ব্যাপার মনের মধ্যে আমার সর্বদাই খচখচ করে অদৃশ্য কাঁটার মত বিধেছে—why at all somebody should be after his life? কেন কেউ তাকে হত্যা করতে চাইবে? কী মোটিভ—কী উদ্দেশ্য, এবং ঐ সঙ্গে আরো একটা যুক্তি মনের মধ্যে এসে আমার উদয় হয়েছে—হত্যার attemptগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটু ফাঁক আছে। একটা বা দুটো attempt ব্যর্থ হতে পারে কিন্তু বার বার চার বার কেন attempt বিফল হবে? শেষবারের attempt-এর পর যে মুহূর্তে ঐ ধরনের অসামঞ্জস্যটা আমার মনকে আকর্ষণ করল, সেই মুহূর্ত হতেই মন আমার সজাগ হয়ে উঠেছে। কঠিন বিশ্লেষণে যুক্তি ও নিরঙ্কুশ বিচারে ঘটনাগুলোকে চিন্তা করতে শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বারবার শুরু করলাম এবং চিন্তা করতে গিয়ে একই জায়গায় এসে বার বার থেমে যেতে হল আমাকে। ব্যাপারটা যুক্তিহীন। এলোমেলো। তারপরই তৃতীয় অধ্যায়ে আমি আসব : শতদল ও সীতার ব্যাপারে। সীতা ভালবেসেছিল সমস্ত প্রাণ দিয়ে শতদলকে কিন্তু শতদল চাইছিল রাণুকে। রাণু ভালবাসে আবার শতদলকে নয়, কুমারেশকে। অর্থ অনর্থ তো ছিলই সঙ্গে এসে যোগ দিল প্রেমের ব্যাপার। একটা জটিল পরিস্থিতির হল উদ্ভব। শতদল চায় রাণুকে, রাণু চায় কুমারেশকে, সীতা চায় শতদলকে। আবার শতদল চায় কুমারেশের ন্যায্য পাওনা থেকে তাকে বঞ্চিত করতে। কুমারেশই হল এক শতদলের পথের কাঁটা দুই দিক দিয়ে। একা রামে রক্ষা নেই তাতে সুগ্রীব দোসর! আকাঙ্ক্ষিতা নারী ও আকাঙ্খিত অর্থ। অতএব কুমারেশকে সরাতে পারলেই দুদিক পরিষ্কার শতদলের। কাজেই কুমারেশের ওপরেই পড়ল শতদলের যত আক্রোশ। শতদল আটঘাট বেধে আসরে অবতীর্ণ হল। শতদলের বুদ্ধির প্রশংসাই করতাম যদি না বড়ের চালে দুটো মারাত্মক ভুল করে নিজে মাত হয়ে না যেত। শেষ পর্যন্ত! এক নম্বর ভুল সে করলে, কুমারেশকে হত্যা না করে এনে বন্দী করে রেখে—কারণ তাতে করে সীতাকে হত্যা করতে হত না। সীতা কুমারেশের কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই তাই হতভাগিনীকে সরাতে হল ইহজগৎ হতে। আর সেইটেই হল শতদলের দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল—অর্থাৎ সীতাকে হত্যা করা। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত সন্দেহের মীমাংসা হয়ে গেল।