হুঁ। তারপর?
চিঠি পেয়ে আমি এখানে আসব কিনা ভাবছি, এমন সময় রাণুর একখানা চিঠি পাই। সেও আমাকে দার্জিলিং থেকে লিখেছে দু-এক দিনের মধ্যেই তারা এখানে আসছে। তখন স্থির করলাম এখানে আসব। মনে মনে যে একটা কৌতূহল হয়নি তাও নয়। যা হোক, এখানে এসে পৌঁছলাম রাত্রের ট্রেনে এবং বলাই বাহুল্য, আগে হরবিলাস দাদকে চিঠিও দিলাম। কুমারেশ থামলেন।
থামলেন কেন? বলুন শেষ করনে। কিরীটী তাগিদ দেয়।
স্টেশনে নেমে বাইরে আসতেই একজন ঢ্যাঙামত লোক এগিয়ে এসে আমাকে প্রশ্ন করল, আমার নাম কুমারেশ সরকার কিনা এবং আমি কলকাতা হতেই আসছি কিনা। জবাবে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে সে বললে সে নিরালার হরবিলাসবাবুর লোক। আমাকে সে নিতে এসেছে। একটা ট্যাক্সি স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তার মধ্যে তার কথামত উঠে বসতেই অন্ধকারে ট্যাক্সির মধ্যে থেকেই কে যেন মাথায় আমার অতর্কিতে আঘাত হানল। সঙ্গে সঙ্গে আমি জ্ঞান হারালাম। জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখি, ছোট্ট একটা ঘরে আমি বন্দী। পরে জেনেছিলাম সেটা নিরালার পিছনে জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের মধ্যের আউটহাউস
একটা কথা মিঃ সরকার, আপনি চেঁচামেচি করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করেননি কেন বন্দী অবস্থায়?
সেও এক বিচিত্র ব্যাপার। ঢ্যাঙা লোকটা আমাকে শাসিয়েছিল, তারা নাকি চিঠি দিয়ে আমার রক্তচাপের রোগী বৃদ্ধ অধ্যাপক বাপকেও নাকি আমারই মত এখানে ধরে এনে অন্য একটা ঘরে আটকে রেখেছে। আমি যদি চেঁচামেচি করি বা গোলমাল করি তারা আমার বৃদ্ধ বাপকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেবে। আর যদি চুপচাপ থাকি তো এক মাস বাদে ছেড়ে দেবে। বাবাকে যে আমি কতখানি ভালবাসি ঐ শয়তানরা জানত বোধ হয়। বাধ্য হয়েই তাই আমাকে কতকটা ঐ বন্দী জীবন মেনে নিতে হয়েছিল। একটিমাত্র জানালা ছিল ঘরের। সেই জানালাপথে সেই ঢ্যাঙা লোকটা প্রত্যহ এসে আমাকে খাবার দিয়ে যেত রাত্রে একবার করে। বন্ধী অবস্থায় আমার কেবলই ঘুম পেত।
Is it?
হ্যাঁ, কেবলই ঘুম পেত। উপযুক্ত আহার না পেয়ে এদিকে ক্রমেই দুর্বল হয়েও পড়ছিলাম।
আপনি টেরও পাননি মিঃ সরকার খাদ্যের সঙ্গে মরফিয়া দিয়ে আপনাকে ঘুম পাড়াত আর উপযুক্ত পরিমাণ আহার না দিয়ে ক্রমে আপনাকে দুর্বল করে ফেলছিল! কিরীটী বললে।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম সব।
তারপর?
তারপর যে রাত্রে সীতা মারা যায়—সেই দিন বিকেলের দিকে ঐ উদ্যানের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে একসময় ঐ outhouse-এর কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ আমাকে দেখতে পায় এবং সীতাই আমাকে উদ্ধার করে ঐদিন সন্ধ্যার দিকে। এবং আমাকে সে অবিলম্বে এখান থেকে চলে যেতে বলে। কারণ, তার বাপ ব্যাপারটা জানতে পারলে নাকি আমাকে হত্যা করবে। আমিও তার নির্দেশমত চলে যাই, কিন্তু পথে গিয়ে মনে হয় শতদলকে সব ব্যাপারটা জানানো উচিত। সঙ্গে সঙ্গে নিরালায় ফিরে আসি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে সামনেই সীতার দেখা পাই। সে তখন ছাদ থেকে নীচে নেমে আসছে। সীতা আমাকে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বসবার ঘরে টেনে নিয়ে যায়।
সে আমাকে বলে, এ কী! আবার আপনি এখানে এসেছেন কেন? একটা সর্বনাশ না করে আপনি ছাড়বেন না দেখছি! বাবা নীচে আছেন এখন, যদি তাঁর চোখে পড়ে যান?
শতদলের সঙ্গে একবার আমি দেখা করতে চাই। তুমি একবার যেমন করে হোক শতদলকে এই ঘরে ডেকে নিয়ে এস।
কিন্তু
না, তার সঙ্গে দেখা না করে আমি যাব না। আমি বললাম সীতাকে। কিন্তু কথা আমার শেষ হল না, ঠিক এমনি সময় দরজার ওপাশ থেকে একটা গুলির আওয়াজ এল ও সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত চিৎকার করে সীতা মাটিতে পড়ে গেল। আমিও আকস্মিক সেই ব্যাপারে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়েছিলাম। এবং ঐ মুহূর্তেই সেখান থেকে পালালাম। পালাই যখন তখন সিঁড়ি দিয়ে কে যেন একটি মহিলা ছাদ থেকে নেমে আসছিল। সে বোধ হয় আমাকে দেখে ফেলেছিল—
হ্যাঁ, শরৎ গুহর মেয়ে কবিতা গুহ। কিরীটী বললে, কিন্তু সে-রাত্রে ভয়ে আপনি যদি অমন করে হঠাৎ না পালিয়ে যেতেন তো আজ রাত্রে আপনাকে গুলি খেতে হত না। তবু, ভাগ্য বলতে হবে যে, গুলিটা আপনার হাতের উপর দিয়েই গিয়েছে। যাক, শেষ করুন আপনার কথা।
নিরালা থেকেও আমি পালালাম। কিন্তু এখান থেকে যেতে পারলাম না। কটা দিন আত্মগোপন করে বেড়িয়েছি আর ব্যাপারটা বুঝবার চেষ্টা করেছি—কী হল। হঠাৎ সীতাকে কে গুলি করে মারল? এমন সময় হরবিলাস দাদু অ্যারেস্ট হয়েছেন আজ সকালে শুনতে পেলাম। তখন ঠিক করলাম সীতার মা হিরণ্ময়ীদির সঙ্গে দেখা করব। এবং তাঁকে সব ব্যাপারটা খুলে বলব। কিন্তু সদর গেট দিয়ে নিরালা ঢুকতে সাহস হল না, সুদূরে পুলিস মোতায়েন দেখে। একটা বাঁশ যোগাড় করে পোলভল্টের সাহায্যে প্রাচীর টপকে নিরালার পিছনের বাগানে প্রবেশ করলাম। তারপর এগুচ্ছি–
এই সময় কিরীটী বাধা দিল, দেখলেন ভুখনা ও কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ আবৃত ছায়ামূর্তিকে বাগানের মধ্যে—তাই না?
হ্যাঁ, আমার ইচ্ছে ছিল লোকটাকে পিছন থেকে গিয়ে জাপটে ধরব, কিন্তু তার আগেই সে আমার উপস্থিতি টের পেয়ে।
গুলি করে! কিন্তু he missed the chance! এবং হত্যাকারী জানতে না যে তার আগেই বাগানে প্রবেশ করে একটা ঝোপের মধ্যে অনতিদূরে আমি আর সুব্রত আত্মগোপন করে আছি!