এখন কেমন আছেন?
এখন একটু ভাল।
হুঁ। ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, কুমারেশবাবুর হাতটা জখম হয়েছে, একটু দেখে ব্যবস্থা করে দিন
নিশ্চয়ই। কিন্তু
সব বলব আপনাকে। আগে হাতটা পরীক্ষা করে ব্যবস্থা করুন—আমরা ততক্ষণ শতদলবাবুর সঙ্গে একটিবার দেখা করে আসি। কথাগুলো বলতে বলতে আরো একটু ডাঃ চ্যাটার্জীর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিম্নকণ্ঠে কিরীটী তাঁকে যেন কী নির্দেশ দিল, তারপর আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, চল সুব্রত!
***
নির্জীবের মত শতদলবাবু তার নির্দিষ্ট কেবিনের মধ্যে শয্যায় শুয়ে ছিল। মাথার সামনে একজন নার্স একটা টুলের উপর বসে ছিল। আমাদের দুজনকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে উঠে দাঁড়াল।
কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে নার্সকে কক্ষত্যাগ করতে বললে। নিঃশব্দে নার্স কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।
কিরীটী অতঃপর শয্যার সামনে এগিয়ে গিয়ে ক্ষণকাল শয্যায় শায়িত নির্জীব শতদলের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর এগিয়ে গিয়ে উদ্যানের দিকে খোলা জানলাটার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়াল। এবং জানালাপথে ঝুঁকে কী যেন দেখতে লাগল বাইরে।
এমন সময় শতদলবাবু চোখ মেলে তাকাল এবং ক্ষীণকণ্ঠে ডাকল, নার্স!
আমি নার্সকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে আমাকে নিষেধ করে শয্যার কাছে এগিয়ে এল।
শতদলবাবু!
কে?
আমি কিরীটী, কেমন আছেন?
মিঃ রায় এসেছেন। আবার আমার life-এর ওপরে attempt নিয়েছিল!
তাই তো শুনলাম।
এবার দুধের সঙ্গে
হ্যাঁ, বড্ড কাঁচা কাজ করে ফেলেছে।
কাঁচা কাজ!
হ্যাঁ। আর সেই জন্যেই সে আমার চোখে ধরাও পড়ে গিয়েছে।
ধরা পড়েছে! শতদলবাবুর কণ্ঠে বিস্ময়।
হ্যাঁ, শতদলবাবু। জানেন একটা কথা, আপনি যে রণধীর চৌধুরীর চিঠিটা আমাকে দিয়েছিলেন—তার মর্মার্থ আমি উদ্ধার করতে পেরেছি।
চিঠি!
হ্যাঁ, মনে নেই আপনার? যে চিঠিটা আপনার কাছ থেকে আমি চেয়ে নিয়েছিলাম?
ও
আর সেই চিঠির মর্মোদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে হত্যাকারীও আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হত্যাকারী?
হ্যাঁ সীতাকে যে হত্যা করেছে। চিঠিটা শিল্পীর একটা অদ্ভুত খেয়ালই বলতে হবে। আর আপনার কথাই ঠিক শতদলবাবু। ঐ চিঠিটাই রণধীর চৌধুরীর উইল!
আমি তো আপনাকে সেই দিনই বলেছিলাম, কিন্তু দিদিমা মানতে চাননি
ভুল করেছিলেন তিনি।
আমি আর নিজের কৌতুহলকে দমন করতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম কিরীটীকে, সত্যি তুই চিঠিটার মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিস কিরীটী?
হ্যাঁ রে। চিঠিটার প্রত্যেকটি লাইলেন পাশে পাশে যে সাংকেতিক অঙ্ক বসানো আছে সেইটাই চিঠিটার মর্মোদ্ধারের সংকেত। এই দেখ পড়। বলতে বলতে চিঠিটা পকেট হতে বের করে কিরীটী আমার হাতে দিয়ে বললে, মোটামুটি চিঠিটায় বলেছে বটে, নিরালা বাড়ি ও তার যাবতীয় সব কিছু আমাদের শতদলবাবুই পাবেন—তবে তার মধ্যে আরো একটা নির্দেশ আছে, সেটা হচ্ছে ঐ সাংকেতিক অঙ্কগুলোর মধ্যে। অঙ্ক অনুসারে প্রত্যেক লাইনের সমানসংখ্যক কথাগুলো নিলে তার অর্থ এই দাঁড়ায়
নির্দেশঃ আমার মত্যুর পর স্টুডিওতে প্রপিতামহের ছবির স্বত্ব কুমারেশের হইবে।
কী বলছেন আপনি মিঃ রায়? শতদল বলে ওঠে।
হ্যাঁ শতদলবাবু। আমার কথা যে মিথ্যা নয় এই চিঠিই তার প্রমাণ দেবে এবং নিরালা ও তার মধ্যেকার যাবতীয় সম্পত্তি আপনি পেলেও, রণধীর চৌধুরীর প্রপিতামহের ছবিটা কুমারেশ সরকারই পাবেন।
কুমারেশ সরকার!
হ্যাঁ, কুমারেশ সরকার। তিনিও আজ এখানে উপস্থিত।
কুমারেশ! কুমারেশকে তাহলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে?
নিশ্চয়ই। ঐ যে—
ঠিক সেই সময় ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে সঙ্গে কুমারেশ সরকার হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা অবস্থায় কেবিনের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন।
কুমারেশবাবু, let us hear your story! আপনি কেমন করে হঠাৎ উধাও হয়ে গিয়েছিলেন, আর কোথায়ই বা এতদিন বন্দী হয়ে ছিলেন কেমন করে?
বিস্মিত কুমারেশ সরকার কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনি সে কথা কী করে জানলেন মিঃ রায়?
অনুমান। অনুমানের ওপর নির্ভর করেই জেনেছি মিঃ সরকার। এখন তো বুঝতে পারছেন, অনুমান আমার ভুল হয়নি! Now let us have the story! কিরীটী বললে।
আশ্চর্য মিঃ রায়, সত্যি আগাগোড়া ব্যাপারটা এখনো আমার কাছে একটা দুর্বোধ্যের মতই মনে হয়। মনে হয় সবটাই যেন প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত একটা দুঃস্বপ্ন। তবু, বলছি শুনুন। কুমারেশ সরকার তাঁর কাহিনী শুরু করলেন– আপনি হয়তো জানেন না মিঃ রায়, শিল্পী রণধীর চৌধুরীর আমি দৌহিত্র হলেও তাঁর সঙ্গে আমাদের কোনদিন কোন সম্পর্ক ছিল না। আমার মাকে তিনি ত্যাজ্য করেছিলেন। আমরাও অর্থাৎ আমার মা-বাবা বা আমি কোনদিন তাঁর সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবারই চেষ্টা করিনি। সেই দাদুর কাছ হতে তাঁর মত্যুর মাসখানেক আগে একটা আবোল-তাবোল লেখা চিত্রবিচিত্র চিঠি পেলাম। আশ্চর্যই হয়েছিলাম। এবং চিঠিটার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারিনি বলে সে চিঠিটা ড্রয়ারের মধ্যেই অবহেলায় পড়ে ছিল, তারপর সাত-আট মাস পরে হঠাৎ হরবিলাস দাদুর একখানা চিঠি পেলাম—
হরবিলাসবাবুর চিঠি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। চিঠিতে তিনি লেখেন, অবিলম্বে কোন বিশেষ অথচ গোপনীয় ব্যাপারের জন্য যেন চিঠি পাওয়া মাত্রই এখানে এসে তাঁর সঙ্গে নিরালায় সাক্ষাৎ করি। অন্যথায় আমার নাকি সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। চিঠিতে এ-ও লেখা ছিল, যাবার আগে তাঁকে যেন আমি পত্র দিয়ে জানাই কবে যাচ্ছি।