কিরীটীর কথা শেষ হল না, হিরণ্ময়ী দেবী চকিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি—আপনি সেসব কথা কেমন করে জানলেন মিঃ রায়!
আপনি না জানলেও আমি জানতাম হিরণ্ময়ী দেবী, আপনার মেয়ে সীতার মনটা কোথায় পড়ে আছে! আরও একটা কথা আপনি হয়তো জানেন না!
কী?
যে ভালবাসার মধ্যে সীতা নিজেকে অমনি নিঃস্ব করে বিকিয়ে দিয়েছিল সেই ভালবাসাই কালসাপ হয়ে তার বুকে মৃত্যু-ছোবল হেনেছে, অথচ বেচারী সে কথা তার শেষ মুহূর্তে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি!
কিরীটীবাবু? আর্ত চিৎকারের মতই ডাকটা শোনায় হিরণ্ময়ীর কণ্ঠে।
হ্যাঁ, হিরণ্ময়ী দেবী। একটা দিকই আপনার নজরে পড়েছে। মালাটাই আপনি দেখেছেন কিন্তু সেই মালার মধ্যেই যে ছিল দংষ্ট্রা কীট সেটা আপনার নজরে পড়েনি!
আমি—আমার যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়! এ সব আপনি কি বলছেন?
সময় আর তো নেই হিরণ্ময়ী দেবী। এখুনি একবার আমাকে নার্সিং হোমে যেতে হবে। কুমারেশবাবুর হাতে গুলি লেগেছে। একটা dressing-এর বিশেষ প্রয়োজন।
কুমারেশ!
হ্যাঁ। দেখুন একে চিনতে পারছেন কিনা?
এতক্ষণ কিরীটী কুমারেশ সরকারকে আড়াল করে দাঁড়িয়েই কথাবার্তা চালাচ্ছিল। এবারে সরে দাঁড়াল।
কে?
চিনতে পারছেন না? বনলতা দেবী ও অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরাণু সরকারের একমাত্র ছেলে কুমারেশ সরকার!
সে কি! তবে যে শুনেছিলাম—
কি শুনেছিলেন? তার কোন পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না, তাই না?
হ্যাঁ।
তার জবাব অবিশ্যি উনিই সঠিক দিতে পারবেন। আচ্ছা এবারে আমরা চলি হিরণ্ময়ী দেবী।
আমরা দুজনে কিরীটীর পিছু পিছু দরজার দিকে অগ্রসর হতেই কিরীটী হঠাৎ আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, হ্যাঁ, একটা ছবি আপনার জিম্মায় রেখে যেতে চাই হিরণ্ময়ী দেবী। সুব্রত, ছবিটা ওঁর কাছেই রেখে যাও। আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী তার বক্তব্য শেষ করল।
ছবি, কিসের ছবি?
আমি ততক্ষণে ঘরের বাইরে গিয়ে ছবিটা এনে হিরণ্ময়ী দেবীর পায়ের সামনে দিলাম। ছবিটা দেখে হিরণ্ময়ী দেবী সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, এ কী! এ ছবিটা দাদার স্টুডিও-ঘরে ছিল না?
হ্যাঁ। আর যত বিভ্রাট এই ছবিটা নিয়েই। এইটা চুরি করবার মতলবেই গতরাত্রে এ বাড়িতে চোরের আবির্ভাব ঘটেছিল।
এই ছবিটা চুরি করতে? কী বলছেন আপনি মিঃ রায়?
হ্যাঁ, বললাম তো। নিরালা-রহস্যের মূলে এই ছবিটাই।
তবে—তবে আমার মেয়ে সীতাকে—
প্রাণ দিতে হল কেন, তাই না আপনার জিজ্ঞাসা হিরণ্ময়ী দেবী? একান্ত অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই আপনার মেয়ে হত্যাকারীর স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, তাই তাকে প্রাণ দিতে হল। কিন্তু আমার আর দেরি করা তো চলবে না—ওদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে।
একটা কথা মিঃ রায়
বলুন।
আমার স্বামী-
সে কথার জবাব তো আজ সকালেই দিয়ে দিয়েছি হিরণ্ময়ী দেবী!
আমরা সকলে অতঃপর নিরালা থেকে বের হয়ে এলাম।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত দুটো বেজে গিয়েছে।
১৮. রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে
রাস্তায় পৌঁছে হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। আমি আর কুমারেশবাবু তাকে অনুসরণ করি।
কিরীটীর শেষের কথাগুলো সমস্ত সংশয়ের অবসান ঘটিয়েছে।
অথচ আশ্চর্য! বার বার ঐ কথাটাই মনে হচ্ছিল। এই দিকটা একবারও আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি কেন? আগাগোড়া ঘটনাটা একটিবারও ঐ দিক দিয়ে আমি বিশ্লেষণ করে দেখিনি কেন?
তাড়াতাড়ি একটু পা চালিয়ে আয় সুব্রত! কুমারেশবাবুর উণ্ডটা dress করাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিরীটী চলতে চলতেই আমাকে একবার তাড়া দিল।
নার্সিং হোমে পৌঁছে দেখি, সেখানে আবার বেশ শোরগোল পড়ে গিয়েছে। ডাঃ চ্যাটার্জী নিজেই একজন ভৃত্যের সঙ্গে কী যেন কথা বলছিলেন।
আমাদের প্রবেশ করতে দেখে বলে উঠলেন, এই যে মিঃ রায়! আবার শতদলবাবুর life-এর ওপরে another attempt হয়েছে। ওকেই আপনার কাছে পাঠাচ্ছিলাম।
ডাঃ চ্যাটার্জীর কণ্ঠস্বরে একরাশ উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে কিরীটীর কণ্ঠস্বরে কোনোরূপ উৎকণ্ঠাই প্রকাশ পেল
অত্যন্ত শান্ত ও নিরুৎসক কণ্ঠে প্রশ্ন করলে, আবার হয়েছিল বুঝি?
হ্যাঁ।
এবারেও poison, না বুলেট!
সেই পূর্বের মতই মরফিন হাইড্রোক্লোর
হুঁ। চলুন দেখা যাক।
এবারেও ঠিক সময়মত ব্যাপারটা জানতে পারায় কোনমতে ভদ্রলোককে বাঁচানো গিয়েছে। কিন্তু আর না মশাই। ও ঝঞ্চাট আর আমার নার্সিং হোমে রাখতে সাহস হচ্ছে না মিঃ রায়, আপনারা অন্য ব্যবস্থা করুন।
ভয় নেই ডক্টর চ্যাটার্জী, হত্যাকারীর এইটাই last show! খেলা তার ফুরিয়েছে, কিন্তু এবারেও কি কড়াপাকের সন্দেশ নাকি?
না, এবারে আরও serious
কি রকম?
হাসপাতালের দেওয়া দুধ পান করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।
হুঁ। তা দুধটা দিয়ে এসেছিল কে কেবিনে?
নার্সই। সে বললে, রাত দশটায় দুধ নিয়ে এসে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকে দেখে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ঘরের আলো নিবিয়ে শতদলবাবু ঘুমোচ্ছেন তাই আর তাঁকে বিরক্ত না করে দুধটা মাথার ধারে মেডিসিন ক্যাবার্ডের ওপরে একটা কাঁচের প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে আসে।
তারপর? কিরীটী পূর্ববৎ নিরাসক্ত ভাবেই প্রশ্ন করে।
তারপর রাত যখন দেড়টা, নার্স বদলির সময় নতুন ডিউটি-নার্স মণিকা গুহ শতদলবাবুর কেবিনের সামনে দিয়ে যেতে যেতে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি কেবিনের মধ্যে প্রবেশ করে আলো জেলে দেখে, শতদল শয্যার উপরে গোঁ-গোঁ করছে। তাড়াতাড়ি আমাকে খবর দেয়, আমি ছুটে যাই—