সমস্ত ব্যাপারটা এত দ্রুত এত আকস্মিক ভাবে ঘটে গেল যে, প্রথমটায় আমরা হতচকিত ও বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্যে।
কেমন করে যে কী ঘটে গেল যেন বুঝতেই পারলাম না।
খেয়াল হতেই দেখি, কিরীটী লাফিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমিও ক্ষিপ্রগতিতে তার পশ্চাদ্ধাবন করলাম।
কিন্তু অকুস্থানে পৌঁছে দেখি, ভুখনা বা সেই কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তির সেখানে চিহ্নমাত্রও নেই। কেবল কে একজন সুট-পরিহিত ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতটা চেপে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে যন্ত্রণাকাতর শব্দ করছে।
উপবিষ্ট লোকটির ওপরে কিরীটীর হস্তধৃত টর্চের তীব্র একটা আলোর রশ্মি গিয়ে পড়ল ও সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী প্রশ্ন করে, কে? এ কি কুমারেশ সরকার!
কুমারেশ সরকার! আমিও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালাম।
কে আপনি? যন্ত্রণাক্লিষ্ট কুমারেশ সরকার প্রশ্ন করেন কিরীটীকে।
আমি কিরীটী। কোথায় গুলি লাগল? দেখি! কিরীটী এগিয়ে গেল।
গুলি করবার আগেই চট করে হেলে পড়েছিলাম ডান দিকে। গুলিটা বাঁ হাতের পাতায় লেগেছে। একটুর জন্য শয়তানটাকে ধরতে পারলাম না, উঃ!
দেখি হাতটা? কিরীটী এগিয়ে গিয়ে কুমারেশ সরকারের গুলিবিদ্ধ আহত রক্তাক্ত বাঁ হাতটা টর্চের আলোয় পরীক্ষা করতে লাগল। পরীক্ষা করে বললে, না, গুলি pierce করে বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু woundটার তো এখনি একটা ব্যবস্থা করা দরকার! বুলেট-উণ্ড—neglect করা যায় না। আমার রুমালটা অপরিষ্কার। সুব্রত, তোর কাছে পরিষ্কার রুমাল আছে।
কুমারেশ বললেন, দেখুন আমার শার্টের ভিতরের পকেটে কাচা রুমাল আছে, বের করুন!
কুমারেশের বুকপকেট হতে পরিষ্কার রুমালটা বের করে কিরীটী কুমারেশের আহত হাতটা বেধে দিল।
কিন্তু লোকগুলো যে পালিয়ে গেল! কুমারেশ বলেন।
পালাবে আর কোথায়? নিজের জালে নিজেই আটকে পড়েছে। অন্যের সঞ্চিত গুপ্তধনের প্রতি লোভ একবার জন্মালে সে লোভ সংবরণ করা বড় দুঃসাধ্য মিঃ সরকার! তাড়াতাড়িতে প্রাণভয়ে সেই বস্তুটিকেই তাঁদের এখানে ফেলে পালাতে হয়েছে যখন, এ জায়গা ছেড়ে তারা বর্তমানে খুব বেশী দূরে যাবে না। না জেনে আগুনে হাত দিলে হাত পোড়েই। সেটাই আগুনের ধর্ম। সে পোড়া হাত খুঁজে বের করতে আমাদের আর খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। কিন্তু কালো কাপড়ে আবৃত মূর্তিটিকে অন্তত আপনার তো চেনা উচিত ছিল মিঃ সরকার, চিনতেই পারলেন না?
না। ভুখনাকে চিনেছিলাম, কিন্তু—
যাক, চলুন আপনার হাতের ক্ষতস্থানটির সর্বাগ্রে একটা ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। চলুন দেখি উপরের তলায় শতদলবাবুর ঘরে, যদি কোন ঔষধপত্র। থাকে! বলতে বলতে কিরীটী আমার দিকে চেয়ে তার বক্তব্য শেষ করল, ছবিটা একা নিয়ে যেতে পারবি না?
কেন পারব না! চল—
আগে আগে কিরীটী ও কুমারেশ সরকার ও পশ্চাতে আমি ছবিটা তুলে নিয়ে অগ্রসর হলাম। বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যেতে হঠাৎ নজরে পড়ল হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরের ভেজানো দ্বারপথের ঈষৎ ফাঁক দিয়ে মৃদু একটা আলোর ইশারা।
আশ্চর্য, হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরে এখনো আলো জ্বলছে! বলতে বলতে সর্বাগ্রে কিরীটী ও পশ্চাতে আমরা দুজনে এগিয়ে গেলাম।
ভেজানো দরজার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে বারেকের জন্য কিরীটী দৃষ্টিপাত করেই দরজাটা খুলে ফেলল। খোলা দ্বারপথে কক্ষের অভ্যন্তর আমাদের দৃষ্টিগোচর হল এবং থমকে দাঁড়ালাম। নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মতই ইনভ্যালিড চেয়ারটার উপরে স্থির অচঞ্চল বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী।
দৃষ্টি তাঁর মাটিতে নিবদ্ধ।
আর সামনেই পায়ের নীচে একরাশ পোড়া কাগজ।
সর্বপ্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে আমি ও কুমারেশ সরকার ছবিটা ঘরের বাইরে দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
ঘরের বাতাসে একটা কাগজপোড়া কটু গন্ধ এবং তখনও পাতলা একটা ধোঁয়ার পর্দা ঘরের মধ্যে ভাসছে।
আমরা যে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম তা যেন হিরণ্ময়ী দেবী টেরই পেলেন না। নিজের মধ্যে এমন গভীর ভাবে নিমগ্ন যে তিনজনের আমাদের কক্ষের মধ্যে প্রবেশের ব্যাপারটা পর্যন্ত তাঁর সমাধিগ্রস্ত মৌনতাকে এতটুকু নাড়াও দিতে পারলে না।
আরো কাছে এগিয়ে গেলাম। তবু, আশ্চর্য, হিরণ্ময়ী দেবীর কোন সাড়া-শব্দ নেই! নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। হিরণ্ময়ী দেবী! মৃদুকণ্ঠে কিরীটী ডাকল।
না, তবু সাড়া নেই। হিরণ্ময়ী দেবী! শুনছেন? ঈষৎ উচ্চকণ্ঠেই এবারে কিরীটী ডাক দিল।
এবারে মুখ তুলে তাকালেন হিরণ্ময়ী দেবী।
ঘরের আলোয় হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকালাম। মড়ার মত ফ্যাকাশে রক্তহীন মুখ। আর দুই চোখের দৃষ্টিও যেন ঘষা কাঁচের মত নিশ্চল প্রাণহীন।
কিরীটী আবার ডাকল, হিরণ্ময়ী দেবী!
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন হিরণ্ময়ী দেবী। কোন সাড়া-শব্দই দেন না।
সর্বস্ব হারানোর এক মর্মান্তিক বেদনা যেন হিরণ্ময়ী দেবীর মুখখানিতে ছড়িয়ে পড়েছে।
সামনের ঐ ভস্মস্তূপের মত যেন তাঁরও সব কিছু আজ শেষ হয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ কথা বলেন হিরণ্ময়ী দেবী, সব পুড়িয়ে ফেলেছি মিঃ রায়! সীতার শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকুও পুড়িয়ে ফেলেছি! কিন্তু কই, তবু তো তাকে ভুলতে পারছি না। কিছুতেই তো মন থেকে তাকে মুছে ফেলতে পারছি না?
যে গিয়েছে তার কথা আর মিথ্যে ভেবে কী লাভ বলুন হিরণ্ময়ী দেবী! বাকি জীবনটা এমনি করেই তার স্মৃতি বার বার আপনার মনের মধ্যে এসে উদয় হবেই। ভেবেছেন কি তার চিঠিপত্রগলো পুড়িয়ে ফেললেই তার স্মৃতির হাত হতে আপনি রেহাই পাবেন! তা আপনি পাবেন না। বরং যে রহস্য এতকাল আপনার কাছে অজ্ঞাত ছিল, তার বাক্স ঘেটে তার চিঠিপত্রগুলো পড়ে