শামুকের মত নিজেকে ও এখন গুটিয়ে রেখেছে। হাজার খোঁচাখুচি করলেও এখন ও মুখ খুলবে না। এ যেন ওর রহস্যের মীমাংসার শেষ চৌকাঠের সামনে এসে নিঃশব্দে শক্তিসঞ্চয় করা। ঘণ্টাখানেক প্রায় সমুদ্রের কিনারে কাটিয়ে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেলে ফিরে এলাম। এবং হোটেলে পৌঁছেই আমাকে কোন কথার অবকাশ মাত্র না দিয়ে কিরীটী দোতলার দিকে চলে গেল।
আমি দ্বিপ্রহরের অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম।
উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে একেবারে ড়ুবে গিয়েছিলাম, হোটেলের ওয়েটারের ডাকে খেয়াল হল।
সার, আপনাদের খানা কি ঘরে দিয়ে যাব?
খানা! হ্যাঁ, নিয়ে এস।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নটা। আশ্চর্য! এখনো কিরীটী ফিরল না? উঠে ডাকতে যাব, কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
সমুদ্রের ধারে রাণু দেবীর সঙ্গে গল্প করছিলাম।
এতক্ষণ ধরে কি এমন গল্প করছিলি?
গল্প নয়, শুনছিলাম। এক প্রেমের জটিল উপাখ্যান।
কার—রাণুর?
হ্যাঁ—তা নয় তো কি হিরণ্ময়ী দেবীর!
ওয়েটার ট্রেতে করে খানা সাজিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।
খানা খাবার পর কিরীটী চেয়ারে শুয়ে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
শয়নের যোগাড় করছি, কিরীটীর কথায় ফিরে তাকালাম, উঁহু, এখন নয়।
তার মানে?
এখন একবার বেরুতে হবে।
এত রাত্রে আবার কোথায় যাবি?
নিরালায়।
১৭. কালো অন্ধকার রাত
কালো অন্ধকার রাত।
সমুদ্রের কিনারা দিয়ে হেঁটে চলেছি দুজনে নিরালার দিকে।
ডাইনে অন্ধকারে গর্জমান সমুদ্র যেন কি এক মর্মভাঙা যাতনায় আছাড়িপিছাড়ি করছে।
নিরালার সামনে এসে যখন পৌঁছলাম হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত প্রায় সোয়া এগারটা।
কিরীটী কিন্তু নিরালার সম্মুখ দিক দিয়ে না প্রবেশ করে পশ্চাতের দিকে এগিয়ে চলল। প্রায় দেড়মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর দড়ির মইয়ের সাহায্যে প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে আমি টপকে নিরালার পশ্চাতে বাগানের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
জমাট অন্ধকারে বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকাটা একটা স্তূপের মত মনে হয়।
নিরালার মধ্যে প্রবেশ করতে চলেছে কিরীটী, কিন্তু কেন, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না! কী তার মতলব?
বাগানের চারিদিকে অযত্ন-বর্ধিত জঙ্গল। অন্য কিছুর না থাক, সাপের ভয়ও তো আছে!
প্রথম দিনের সেই সীতার সতর্কবাণী মনে পড়ে। নিরালায় ভয়ানক সাপের উপদ্রব।
শুধু কি তাই? সীতার কুকুর টাইগার! কে জানে সেই মত্যুসদৃশ অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা ছাড়া আছে কিনা? সীতার মুখখানা যেন কিছুতেই ভুলতে পারি না। কেবলই ঘুরে-ফিরে মনে পড়ে সেই মুখখানা। সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে অন্ধকারে এগুচ্ছি কিরীটীর পিছু পিছু।
কী কুক্ষণেই যে সমুদ্রের ধারে হাওয়া বদলাতে এসেছিলাম ওর প্ররোচনায় পড়ে!
পৈতৃক প্রাণটা শেষ পর্যন্ত বেঘোরে না হারাতে হয়!
কোন প্রশ্ন যে করব ওকে তারও কি জো আছে? এখনি হয়তো খিঁচিয়ে উঠবে। নচেৎ বোবা হয়ে থাকবে। হঠাৎ একটা খসখস শব্দ কানে এল।
চকিতে কিরীটী আমাকে ঈষৎ আকর্ষণ করে একটা ঝোপের মধ্যে টেনে বসে পড়ল। আবছা আলো-অন্ধকারে শ্যেনদৃষ্টি মেলে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পূর্বে আকাশে একফালি চাঁদ জেগেছে। ক্ষীণ অস্পষ্ট সেই চাঁদের আলো আশপাশের গাছপালার উপরে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত একটা আলো-ছায়ার সষ্টি করেছে।
খুব স্পষ্ট না হলেও দেখতে কষ্ট হয় না। ঢ্যাঙা-মত একটা ছায়া অন্ধকারে নিরালার পশ্চাতের বারান্দায় দেখা গেল। বারান্দা দিয়ে লোকটা পা টিপে টিপে এই দিকেই আসছে।
আরো একটু কাছে এলে দেখলাম, লোকটার দুই হাতে ধরা প্রকাণ্ড একটা কি বস্তু!
কিরীটীর দিকে তাকালাম। তার শ্বাস-প্রশ্বাসও যেন পড়ছে না। স্থির অপলক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে।
কে লোকটা? হাতে ওর ধরাই বা কী?
আরো একটু এগিয়ে আসতেই এবারে বুঝতে কষ্ট হল না, লোকটার হাতে ধরা বস্তুটি কী? প্রকাণ্ড একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ছবির ফ্রেমে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। এবং লোকটাকেও এবারে চিনতে কষ্ট হল না। এ বাড়ির সেই বোবা-কালা ভুখনা! কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ভুখনা ছবিটা নিয়ে?
চাপা স্বরে আস্তে আস্তে কিরীটীকে সম্বোধন করে বললাম, ভুখনা!
হ্যাঁ, চুপ!
ভুখনা ছবিটা নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল বাগানের মধ্যেই। বাগানের দক্ষিণ কোণে একটা প্রশস্ত ঝাউগাছ, তার নীচে এসে দাঁড়াল ভুখনা এবং ছবিটা মাটিতে নামিয়ে রাখল।
চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় পরিষ্কার না হলেও আমরা সবই দেখতে পাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম পাশের ঝোপ থেকে আর একটি ছায়ামূর্তি বের হয়ে এল। ছায়ামূর্তির সর্বাঙ্গ একটা কালো কাপড়ে ঢাকা। মুখে বাঁধা একটা কালো রুমাল, সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তি ভুখনাকে চাপা স্বরে কী যেন বললে।
ওদের ব্যবধান আমাদের থেকে প্রায় হাত-আষ্টেক হওয়ায় বুঝতে পারলাম না কী কথা বললে!
কিন্তু ও কি? ভুখনা ও ছায়ামূর্তির ঠিক পশ্চাতে গুটি গুটি পা ফেলে তৃতীয় আর একজন এগিয়ে আসছে। এসব কী ব্যাপার!
অতি সতর্কতার সঙ্গে পিছন থেকে তৃতীয় আগন্তুক এগিয়ে আসলেও, কালো কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তির অতি সতর্ক শ্রবণেন্দ্রিয়কে ফাঁকি দিতে পারেনি। মুহূর্তে চোখের পলকে কাপড়ে আবৃত ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ায় ও আধো-আলো আধো-অন্ধকারে একটা অগ্নিঝলক ঝলসে ওঠে ও সেই সঙ্গে শোনা যায় পিস্তলের আওয়াজ—দুড়ুম! সেই সঙ্গে শোনা গেল একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার।