শরৎবাবু বাসায় ছিলেন না, একটু আগে আদালতে বের হয়ে গিয়েছেন। কবিতা দেবী আমাদের বসতে বললেন।
আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল কবিতা দেবী! কিরীটীই কথা শুরু করে।
না, না—এর মধ্যে বিরক্তির আর কী আছে!
ঘোষাল সাহেব হরবিলাসবাবুকে শতদলবাবুর হত্যা-প্রচেষ্টার ব্যাপারে অ্যারেস্ট করেছেন কিছুক্ষণ আগে
সে কি! হরবিলাসবাবু–
হ্যাঁ, তবে তাঁর মুক্তির ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনার evidence-এর ওপরে।
আমার evidence-এর ওপরে?
হ্যাঁ।
কিন্তু আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!
হরবিলাসবাবু বলতে চান যে, তিনি আপনার কাছে গত পরশু এসে শতদলবাবুকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাতে বলেননি, অথচ ঘোষাল সাহেবের ধারণা তিনিই এসেছিলেন! কিরীটী জবাব দিল।
কিন্তু আমি তো বলিনি যে হরবিলাসবাবু এসেছেন! একটা ঢোক গিলে কবিতা জবাব দেন।
তিনি যদি না-ই এসে থাকবেন, তাহলে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা আজ সকালে আপনার এই ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া গেল কি করে? কথাটা বললেন ঘোষাল।
আংটির পাথর কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে এই ঘরে?
হ্যাঁ।
কে পেয়েছেন?
মিঃ রায়।
সত্যি! কথাটা বলে কবিতা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
হ্যাঁ।
কই দেখি সে পাথরটা?
কিরীটী একান্ত নির্বিকার ভাবেই যেন জামার পকেট হতে হাত ঢুকিয়ে প্রবাল পাথরটা বের করে কবিতার চোখের সামনে ধরল।
আশ্চর্য! এই তো—এটা তো আমার আংটির পাথরটা! কাল কখন আংটি থেকে পড়ে গিয়েছে, খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
আপনার আংটির পাথর! কই, আপনার আংটিটা কই?
আংটি হতে পাথরটা পড়ে যাওয়ায় আজ সকালেই বাক্সে তুলে রেখেছি।
দয়া করে আংটিটা আনবেন কি?
নিশ্চয়ই। কিরীটীকে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের সময় না দিয়ে কবিতা উঠে ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাথরহীন একটা আংটি নিয়ে এল।
এই দেখুন!
কিরীটী আংটিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে আড়চোখে একবার কবিতার দিকে তাকিয়ে বললে, কিন্তু এ আংটিটা তো আপনার হাতের আঙুলে fit করবার কথা নয় কবিতা দেবী! এটা কার আংটি?
কেন, আমার?
উঁহু। কই পরুন তো!
এবারে কবিতা দেবী যেন একটু বিমূঢ় হয়ে পড়েন। একটু বিহ্বল। হতচকিত।—অবিশ্যি আংটিটা একটু আঙুলে আমার বড়ই হয়—
তাই তো বলছিলাম, সত্যি করে বলুন তো আংটিটা কার?
আমারই।
না, কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে আংটিটা দিয়েছেন! তাই নয় কি কবিতা দেবী?
হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে জবাব দিলেন কবিতা।
কে কে দিয়েছেন?
ক্ষমা করবেন কিরীটীবাবু, ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত।
হুঁ।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে।
পরশু কে আপনাকে এসে বলেছিল, শতদলবাবুকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাতে নার্সিং হোমে?
তাকে চিনি না, দেখিনি কখনো।
দেখতে কেমন?
বয়েস পঞ্চাশের নীচে হবে বলে মনে হয় না। মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।
নাম কিছু বলেনি?
না, জিজ্ঞাসা করিনি।
কোথা হতে আসছে তা বলেনি?
হ্যাঁ, বলেছিল নার্সিং হোম থেকেই। সেখানেই নাকি কাজ করে।
আচ্ছা কবিতা দেবী, বিখ্যাত সুইমার কুমারেশ সরকারের নাম শুনেছেন?
কিরীটীর আচমকা বিষয়ান্তরে গিয়ে সম্পূর্ণ ঐ নতুন প্রশ্নে কবিতা প্রথমটা বোধ হয় একটু কেমন বিস্ময়ে বিহবল হয়ে পড়ে এবং ক্ষণকাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তারপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়, নাম শুনেছি, কিন্তু সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নেই।
কিরীটী এরপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আচ্ছা তাহলে চলি। নমস্কার।
হোটেলে প্রত্যাগমন করে আহারাদির পর কিরীটী ঘরের মধ্যে একটা আরামকেদারায় শুয়ে চোখ বুজল।
আমি একটা বাংলা বই নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলাম। সারা সকাল হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে কখন দু-চোখের পাতা বুজে এসেছিল টের পাইনি।
ঘুম ভাঙল একেবারে সন্ধ্যার দিকে। তাড়াতাড়ি শয্যার ওপরে উঠে বসতেই নজরে পড়ল কিরীটী নিঃশব্দ অস্থির পদে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। এবং হাতে তার শতদলবাবুর নিকট হতে চেয়ে নিয়ে আসা রণধীরের চিত্রাঙ্কিত চিঠিটা।
চা খেয়েছিস? প্রশ্ন করলাম।
বাবাঃ, ঘুম ভাঙল তোর?
হ্যাঁ। খুব ঘুমিয়েছি নাকি?
না, মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা! চল, চা খেয়ে একটু বেরনো যাক।
আগে শয্যা হতে উঠে সুইচ টিপে আলোটা জাললাম। তারপর বেরিয়ে গিয়ে বেয়ারাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে এসে দেখি, চেয়ারটার উপরে উপবেশন করে সেই চিত্রাঙ্কিত হিজিবিজি-মাকা চিঠিটা কিরীটী গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে।
ব্যাপার কি তোর বল, তো কিরীটী? চিঠিটার মর্মোদ্ধারের প্রতিজ্ঞা নিয়েছিস নাকি?
মর্মোদ্ধার হয়ে গিয়েছে এবং নিরালার রহস্যের উপরেও কাল প্রত্যুষেই যবনিকাপাত!
সত্যি?
হ্যাঁ।
চা-পান করে দুজনে হোটেল থেকে বের হলাম।
পথে নেমে কিরীটী বললে, চল, একবার ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ঘোষাল সাহেব থানাতে ছিলেন না। কাছে-পিঠেই নাকি কোথায় এনকোয়ারিতে গিয়েছেন। এ, এস, আই, রামকিঙ্কর ওঝা ছিলেন। খসখস করে কাগজ ও পেন দিয়ে একটা চিঠি লিখে চিঠিটা খামের মধ্যে পরে সেটা ওঝার হাতে দিয়ে আমরা থানা হতে বের হয়ে এলাম। বুঝতে পারছি কিরীটীর বাইরের শান্ত ভাবটা মুখোশ মাত্র। ভিতরে তার যে ঝড় চলেছে সেটাকে সে চাপা দিতে পারছে না। এবং রহস্যের মীমাংসার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে বলেই নিজেকে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বাইরে ধীর ও শান্ত রাখার জন্য।