তোর কি তাহলে ধারণা যে, ঐ বাড়িটার সঙ্গেই কোন রহস্য জড়িয়ে আছে কিরীটী?
নিশ্চয়ই, নচেৎ এমন অকস্মাৎ বুলেটের আবির্ভাব ঘটবে কেন?
কিন্তু একটা কথা তোকে না বলে পারছি না। বুলেটটা যেন বুঝলাম, কিন্তু রিভলবারের—
কথাটা আমায় কিরীটী শেষ করতে না দিয়েই বলে ওঠে, আওয়াজটা শুনতে পাসনি, এই তো? কিন্তু বললাম তো
কিন্তু–
রিভলবারের সঙ্গে সাইলেন্সার ফিট করা ছিল। কিন্তু গুলিটা এল কোন দিক থেকে?
পূর্ব দিক অর্থাৎ সাগরের দিক থেকেই এসেছে বলে আমার মনে হয়।
ঐসময় সেই দিকে অত লোকজন ছিল!
সেটা তো আরো চমৎকার কেমোফ্লাজ-শতদলবাবুর দিক থেকে সামান্য একটুক্ষণের জন্য আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম সুব্রত, তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এবং ঠিক সেই মুহূর্তটিতে ব্যাপারটা ঘটে গেল, নচেৎ আমার দৃষ্টিকে সে এড়াতে পারত না।
সহসা একটা আনন্দ-মিশ্রিত হাসির শব্দে চমকে ফিরে তাকালাম। মাত্র হাত-আট-দশ দূরে সমুদ্রের ধার দিয়ে শতদল ও রাণু, পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।
এবং রাণু ও শতদল দুজনেই খুব হাসছে।
চমৎকার মানিয়েছে কিন্তু ওদের দুজনকে কিরীটী! চেয়ে দেখ, a nice pair!
আমি ওদের সম্পর্কে বিশেষ করে বলা সত্ত্বেও কিরীটী ফিরে তাকাল না, কেবল মৃদুকণ্ঠে বললে, নির্জন সাগরকূলে পাহাড়ে উপরে এক দুর্গ গড়ে তুলেছিল এক আপনভোলা শিল্পী। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সেই দুর্গের মধ্যে শিল্পী বসে বসে কখনো আঁকত ছবি, কখনো গড়ত মূর্তি, কিতু তার চাইতে বড় কথা—আমাদের দেশে যে একটা প্রবাদ আছে, মরা হাতির দামও লাখ টাকা—যদি সেই দিক দিয়ে ভাবা যায়, তাহলে কী দাঁড়ায় বল?
কিন্তু উত্তরাধিকারী শতদলবাবুই তো একটু আগে বলে গেলেন, অবশিষ্ট এখন মাত্র ঐ গৃহখানিই। সম্পত্তির আর কিছু অবশিষ্ট নেই–
তারই দাম লাখ টাকা। চল, ওঠা যাক। হোটেলে গিয়ে আপাততঃ তো এক কাপ গরম চা সেবন করা যাক। বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল এবং হোটেলের দিকে চলতে শুরু করল। আমি তাকে অনুসরণ করলাম।
সমস্তটা দ্বিপ্রহর কিরীটী হোটেলের সামনের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারের উপরে হেলান দিয়ে একটা মোটামত বাংলা উপন্যাস নিয়েই কাটিয়ে দিল।
সকালের ব্যাপারে তাকে বিশেষভাবে যে একটু উত্তেজিত বলে মনে হয়েছিল, সে উত্তেজনার যেন এখন অবশিষ্টমাত্রও নেই। তার হাবভাব দেখে মনে হয় ব্যাপারটা যেন সে ইতিমধ্যেই একেবারে ভুলেই গিয়েছে। মনের মধ্যে তার কোন চিহ্নমাত্রও নেই।
বাইরে শীতের রৌদ্র ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে এসেছে। নিভন্ত দিনের আলোয় সমুদ্রও যেন রূপ বদলিয়েছে। বিষণ্ণ ক্লান্তিতে সমুদ্রের নীল রঙ কালো রূপ ক্রমে ক্রমে নিচ্ছে যেন। এ বেলা আর স্নানার্থীদের কোন ভিড় নেই। তবু বায়ুসেবনকারীদের চলাচল শুরু হয়েছে।
হোটেলের ভৃত্য শিবদাস চায়ের ট্রেতে করে চা ও কিছু কেক বিস্কুট রুটি জ্যাম সামনের টেবিলের ওপরে এনে নামিয়ে রাখল।
কিরীটী একমনে পড়ছে দেখে আমিই উঠে চায়ের কাপে চা ঢেলে কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, চা!
কিরীটী হাতের বইটা মুড়ে কোলের উপর নামিয়ে রেখে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিল। উষ্ণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, তোর সঙ্গে টর্চ আছে না সুব্রত?
আছে।
কেডস জুতো আছে?
না, তবে আমার ক্রেপ-সোলের জুতো— ওতেই হবে। কোথাও বের হবি নাকি?
হ্যাঁ, নিরালা দর্শনে যাব।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে দুজনে নিরালার দিকে অগ্রসর হলাম। সূর্যাস্তের পূর্বে ওখানে আমাদের পৌঁছতে হবে। কিরীটী বলল।
তা আর পারা যাবে না কেন?
ক্ৰমে লোকালয় ছেড়ে সমুদ্রের কোল ঘেষে অপ্রশস্ত একটা পায়ে-চলা পথ ধরে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম। সমুদ্র যেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। টের পাচ্ছি সমুদ্রের পাড় যেন ক্রমে সমুদ্র থেকে উঁচু হয়ে চলেছে। সমুদ্রের গর্জমান ঢেউগুলো পাড়ের গায়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ভেঙে আবার পিছিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গাটায় সমুদ্রের পাড়টা বড় বড় পাথর দিয়ে বাঁধানো। মধ্যে মধ্যে বড় বড় এক-একটা ঢেউ বাঁধানো পাড়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলকণার ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বিকেল থেকেই হাওয়াটাও যেন বেড়েছে।
ক্ৰমে খাড়াই পথ ধরে আমরা উপরের দিকে উঠছি। চমৎকার বাঁধানো পথ। সূর্য ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে অনেকটা নেমে এসেছে পশ্চিম দিগবলয়ে।
তিন-চারশো ফুটের বেশী পাহাড়টা উঁচু হবে না।
ক্রমে যত উপরের দিকে উঠছি, ডান দিকে সমুদ্র আরো স্পষ্ট ও অবারিত হয়ে ওঠে। ভারি চমৎকার দৃশ্যটি।
এমন জায়গায় শিল্পী না হলে কেউ এত খরচ করে বাড়ি করে!
কিরীটীর কথায় সায় না দিয়ে আমি পারলাম না, যা বলেছিস। লোকটা সত্যিই শিল্প-পাগল ছিল।
আরো কিছুর উপরের দিকে উঠতেই একটা লোহার গেট দেখতে পেলাম। এবং গেটের সামনে দাঁড়াতেই বাড়িটার সামনের দিকটা সুস্পষ্ট হয়ে চোখের উপর ভেসে উঠল।
মুঘল যুগের স্থাপত্যশিল্পের পরিপূর্ণ একটি নিদর্শন যেন বাড়িখানি। দ্বিতল বাড়িটা, চারদিকে চারুটি গোলাকার গম্বুজ। গম্বুজের গায়ে বোধ হয় নানা রঙের পেটেন্ট স্টোন বসানো, অস্তমান সূর্যের শেষ রশ্মি সেই পাথরগুলোর ওপরে প্রতিফলিত হয়ে যেন মরকতমণির মতো জ্বলছে।
বাড়িটার সামনেই একটা নানাজাতীয় ফুল-ফলের বাগান। গেট বন্ধ ছিল, এক পাশের থামে শ্বেতপাথরের প্লেটে সোনালী অক্ষরে বাংলায় লেখা নিরালা।