কিরীটীর স্পষ্টাস্পষ্টি অভিযোগেও হিরণ্ময়ী দেবী নিঃশব্দে বসে রইলেন। কোন সাড়া দিলেন না।
আমার কি বিশ্বাস জানেন হিরণ্ময়ী দেবী! কিরীটী আবার কথা বললে। হিরণ্ময়ী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
দূতরূপেই মিঃ ঘোষ কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন। এবং সে-কথা কবিতা দেবীর কাছ হতে বের করতে আমায় বিশেষ কষ্ট পেতে হবে না। কিন্তু আমি চাই আপনিই সব কথা আমাকে খুলে বলুন।
আমি কিছু জানি না। হিরণ্ময়ী দেবীর সমস্ত মুখখানা যেন পাথরের মত কঠিন মনে হয়।
তাহলে একান্ত দুঃখের সঙ্গেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এর পর আপনার স্বামীকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর আমাদের দ্বিতীয় পথ থাকবে না!
কিন্তু আপনি নিজের মুখেই তো একটু আগে বললেন যে, আমার স্বামী শতদলকে হত্যা করবার প্রচেষ্টার ব্যাপারে নিদোষ?
তা বলেছি। তবে তাঁকে ঘিরে যে সন্দেহ জমে উঠেছে, সেটা যতক্ষণ না পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তাঁকে মুক্তি দেওয়াও তো সম্ভব নয়। আপনিই বলুন না! শুনুন হিরণ্ময়ী দেবী, আমি জানি এ সব কিছুর মূলে কে–
বিদ্যুৎ-চমকের মতই হিরণ্ময়ী কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, আপনি —আপনি জানেন?
হ্যাঁ, জানি।
তবে—তবে আপনি তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?
ব্যস্ত হবেন না। সময় হলে আপনা হতেই তাকে হাজতে গিয়ে ঢুকতে হবে।
কিন্তু
আপনার কাছে আমি যা জানতে চাইছি বলুন!
কি বলব?
বলুন কেন সেদিন আমাদের কাছে আপনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন যে, স্বর্গত রণধীর চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়েটির কথা আপনি কিছু জানেন না? সোমলতা আর বনলতা—তাদের সমস্ত কথা এখনো আপনি বলেননি!
বনলতা আর সোমলতা দুজনেই মারা গেছে।
শতদলবাবু কার ছেলে?
সোমার।
আর বনলতার স্বামীই বা কে? আর তার সন্তান কটি?
বনলতার স্বামীর নাম ডঃ শ্যামাচরাণ সরকার।
হিরণ্ময়ী দেবী কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর সমস্ত সত্তা যেন সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সজাগ হয়ে ওঠে। উদগ্রীব ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কী– কী বললেন?
ডঃ শ্যামাচরণ সরকার—বনলতার স্বামী।
কোন শ্যামাচরণ সরকার? অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরণ সরকার কি?
হ্যাঁ।
কিরীটীর চোখে-মুখে ক্ষণপূর্বে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, সেটা যেন আবার নিভে এল। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলে, তাহলে—তাহলে হরবিলাসবাবু কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন কেন?
আপনাকে তো আমি বললাম, আমার স্বামী সেখানে যাননি! এবং কবিতার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও নেই।
তা হতে পারে না। Simply absurd! একেবারে অসম্ভব। নিশ্চয়ই হরবিলাসবাবু কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন। এবং তিনি শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে ফুল ও মিষ্টি পাঠাতে বলেও এসেছিলেন, এ-ও সত্যি। কিন্তু এইটাই বোঝা যাচ্ছে না, কেন—কেন তিনি ও-কথা কবিতা দেবীকে বলতে গেলেন। তারপর একটু থেমে কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা হয় তাহলে–,কিরীটী শেষের কথাগুলো খুব ধীরে যেন উচ্চারণ করল এবং পরক্ষণেই হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, আপনার স্বামীর হাতের আংটিটা কত দিন ওঁর হাতে আছে বলতে পারেন?
তা দশ-বারো বছর তো হবেই।
বলতে পারেন আপনার স্বামীর হাতের আংটিটার পাথরটা—যেটা তাঁর আংটিতেই আছে, শেষবারে কবে আপনার নজরে পড়েছিল?
সীতার মৃত্যুর আগের দিনও আংটির পাথরটা ঠিক ছিল—যেন দেখেছি বলেই মনে হয়।
তাহলে আর কি হবে! চল সুব্রত, ওঠা যাক। আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলল।
কিরীটীই প্রথমে কক্ষত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয় এবং আমিও উঠে দাঁড়াই।
আমাদের কক্ষত্যাগ করতে উদ্যত দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে হিরণ্ময়ী বলে ওঠেন, কিন্তু আমার স্বামী?
কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্তকণ্ঠে বললে, আংটির পাথরের ব্যাপারটা যতক্ষণ না মীমাংসিত হচ্ছে, আপনার স্বামীকে হাজতে নজরবন্দী থাকতেই হবে হিরণ্ময়ী দেবী। আমি দুঃখিত।
বিনা দোষে আমার স্বামীকে হাজতবাস করতেই হবে?
দোষের কথা তো এখানে নয়, সন্দেহক্রমে—
অতঃপর হরবিলাসকে সঙ্গে নিয়েই আমরা নিরালা থেকে বের হয়ে এলাম। পথে বের হয়ে কিরীটীর নির্দেশক্রমে দুজন সেপাইয়ের হেপাজতে হরবিলাসকে থানায় পাঠিয়ে দিয়ে কিরীটী ঘোষাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন, আর একবার শরৎ উকিলের বাসাটা ঘুরে যাওয়া যাক!
এখুনি? বেলা অনেক হয়েছে, সন্ধ্যার দিকে গেলে হত না? প্রশ্নটা করলেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল।
না, শুভস্য শীঘ্রম। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।
শহরের পথে চলতে চলতে আমি একটা কথা কিরীটীকে না স্মরণ করিয়ে দিয়ে পারলাম না, নিরালার উপরের ঘর—যার তালা ভাঙা ছিল, সে ঘর দেখা হল না!
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বললে, ব্যস্ততার কী আছে? দেখলেই হবে! বেলা তখন প্রায় একটা হবে।
মধ্যাহ্ন-সূর্য মাথার উপরে প্রচণ্ড তাপ বর্ষণ করছে। কিরীটীর দ্রুত পদবিক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছিল, মনে মনে সে যেন বিশেষ কোন একটা মীমাংসায় উপনীত হতে চলেছে। বারবারই লক্ষ্য করেছি, কিরীটী যখন কোন একটা জটিল ব্যাপারে মীমাংসার কাছাকাছি আসে, তার চালচলন কথাবার্তা এমনি দ্রুত ও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। তার অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাব যেন সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে।
ঠিক দ্বিপ্রহরে ঐদিন দ্বিতীয়বার আবার আমাদের তাঁর ওখানে আসতে দেখে কবিতা দেবী বেশ যেন কিছুটা বিস্মিতই হন।