সেই পড়ে গিয়ে পিঠের শিরদাঁড়ায় প্রচণ্ড আঘাত লাগল। তিন মাস শয্যায় পড়ে রইলাম। সুস্থ হলাম, কিন্তু
কিন্তু জন্মের মত আপনার শিরদাঁড়ার হাড় নষ্ট হয়ে গিয়ে একটা কুঁজের মত হয়ে গেল! কথাটা বললে কিরীটী।
হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে?
কারণ প্রথম দিন আপনার দুই পা ও কোমরের গঠন থেকেই বুঝেছিলাম, আপনি যে বলেছিলেন paralysis-এ আপনি ভুগছেন সেটা সত্যি নয়। কোমরে বা পায়ে আপনার কোন রোগ নেই। ইনভ্যালিড চেয়ারের আপনি ভেক নিয়েছেন অন্য কোন কারণে। এবং দ্বিতীয় দিনেই আমার দৃষ্টিতে আপনার পিঠের কুঁজটা ধরা পড়ে গিয়েছিল এবং বুঝেছিলাম ঐ কারণেই নিজের বিকল দেহটাকে ঢেকে রাখবার জন্য আপনি সর্বদা ইনভ্যালিড চেয়ারে বসে থাকেন।
ঠিক তাই। দীর্ঘদিন ধরে ইনভ্যালিড চেয়ার ব্যবহার করে করে এখন এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু যা বলছিলাম—
হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর অসমাপ্ত কাহিনী আবার শুরু করলেন–
হিরণ্ময়ী কিন্তু তবু পিতৃসম্পত্তির লোভ দমন করতে পারলেন না। রণধীরের কাছে বাপের লেখা চিঠিটার কথা উল্লেখ করলেন।
বাবার চিঠির দ্বারাই আমি প্রমাণ করব বাবার সম্পত্তির অর্ধেক আমার!
তা করতে পার, তবে ঐ সময় এ কথাও আমি কোর্টে প্রকাশ করব। তোমার সত্যকার পরিচয়। তার চাইতে আমি যা বলি তাই করো।
কি?
বিশ হাজার টাকা তোমাকে আমি নগদ দেব। আর আমার উইলে provision রেখে যাব, তোমার ও আমার সন্তান আমার সম্পত্তি সমান ভাগে পাবে।
কিন্তু তোমাকে বিশ্বাস কি! যদি তুমি তোমার কথা না রাখ?
লিখে দিচ্ছি—
বেশ, তাহলে রাজী আছি।
কিন্তু চিঠির মধ্যে এই শর্তও থাকবে, কোনক্রমে ঐ চিঠি যদি আমার মৃত্যুর পূর্বে প্রকাশ পায় তো ঐ condition নাকচ হয়ে যাবে। রাজী আছ তাতে?
রাজী।
সেই ভাবেই রণধীর একখানা চিঠি লিখে দিলেন।
নগদ কুড়ি হাজার টাকা ও চিঠি নিয়ে হিরণ্ময়ী ফিরে গেলেন স্বামীকে নিয়ে কলকাতায়। একেবারে রিক্তহস্তে ফিরে যাওয়ার চাইতে তবু কিছু পাওয়া গেল।
তার পর দীর্ঘ ষোল বৎসর দুজনে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। তবে হিরণ্ময়ী শুনেছিলেন, রণধীর তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দুই যমজ কন্যা বনলতা ও সোমলতাকে নিয়ে নিরালায় এসে বসবাস করছেন।
কিরীটী আবার এইখানে বাধা দিল, ঐ ছবি দুটি তাহলে তাদেরই? হ্যাঁ, বনলতা আর সোমলতা দুই বোন। দাদারই হাতে আঁকা ছবি।
তবে যে আপনি সেদিনকার আমার প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বনলতা আর সোমলতা একে অন্য হতে চার-পাঁচ বছরের ছোট-বড়? মিথ্যা বলেছিলেন বলুন?
হ্যাঁ।
১৬. দেওয়ালে টাঙানো অয়েল-পেন্টিং
আমি তাকিয়ে ছিলাম দেওয়ালে টাঙানো পাশাপাশি অয়েল-পেন্টিং দুটোর দিকে।
সোমলতা আর বনলতা শিল্পী রণধীর চৌধুরীর দুই মেয়ে। টুইন যমজ বোন। এবং ওদেরই একজনের ছেলে শতদল। কিন্তু শতদল কার ছেলে–বনলতার না সোমলতার! শশাঙ্ক চৌধুরীর ছেলে রণধীর চৌধুরী আর হিরণ্ময়ী দেবী।
হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আরো যেন তাঁর কিছু বলার আছে, কিন্তু তিনি যেন বলতে পারছেন না। চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে কিরীটীর দিকে তাকালাম। গভীর কোন চিন্তার মধ্যে ও ড়ুবে আছে। হস্তধৃত জলন্ত সিগারেটটা নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কোন একটা বিশেষ চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু সেটা কী? হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে কী এমন সে পেল চিন্তার খোরাক? শতদল-রহস্য-কাহিনীর কোন সূত্র কি সে খুঁজে পেল? একটু আগে রাস্তায় আসতে আসতে কিরীটী বলেছিল, অন্ধকারে সে আলো দেখতে পেয়েছে। মাত্র একটি জায়গায় সুত্রে এসে জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে। হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে কি সেই সূত্রটিই ও খুঁজে পেল? আমি তো কই কিছুই এখনো ভেবে পাচ্ছি না! কেন শতদলবাবুর প্রাণের ওপরে এমনি বার বার প্রচেষ্টা হল? আর কেই বা তাঁকে বার বার হত্যা করবার চেষ্টা করছে?
আচমকা কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
এইটুকুই কি আপনার বলবার ছিল হিরণ্ময়ী দেবী? আর কি কিছুই আপনার বলবার নেই? কিরীটীর দু’চক্ষুর শাণিত দৃষ্টি সম্মুখে উপবিষ্ট হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের ওপরে স্থিরনিবদ্ধ।
অ্যাঁ! হিরণ্ময়ী যেন চমকে উঠলেন। আপনার কি বলবার আর কিছুই নেই?
না। ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ।
আপনি তো কই এখনো বললেন না, আপনার স্বামী কবিতা দেবীর বাড়িতে কেন গিয়েছিলেন?
আমি যতদূর জানি আমার স্বামী এ দুদিন মোটে বাড়ি থেকে বেরই হননি।
হ্যাঁ, আপনার জানিত-ভাবে বের হননি এটা বিশ্বাস করি, কিন্তু তিনি যে গিয়েছিলেন এটাও ঠিক। কারণ দৈবক্রমে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা সেখানে খসে পড়ে গিয়েই, সেখানে যে তিনি গিয়েছিলেন সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে হিরণ্ময়ী দেবী! এক্ষেত্রে অস্বীকার করেও তো উপায় নেই। দৈবই যে প্রতিকূল!
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মিঃ রায়, আমার স্বামীর শতদলকে হত্যা করবার কোন কারণই নেই এবং তিনি তা করবার চেষ্টাও করেননি।
আমি বিশ্বাস করি হিরণ্ময়ী দেবী, হরবিলাসবাবু সে কাজ করেননি কিন্তু তিনি যে শরৎবাবুর বাসায় গিয়েছিলেন, যে কোন কারণেই হোক—সেটা আমার স্থিরবিশ্বাস। এবং অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো হরবিলাসবাবু, আপনার জ্ঞাতসারেই সেখানে গিয়েছিলেন!