আর কেউ ঘরের মধ্যে উপস্থিত হিরণ্ময়ী দেবীর শেষের কথাগুলোর তাৎপর্য সম্যক উপলব্ধি করতে না পারলেও আমি পারলাম।
কিরীটীবাবু, সব কথাই আমি বলব। কিন্তু বলবার আগে একমাত্র আপনি ও ইচ্ছা করলে সুব্রতবাবু, ব্যতীত আর সকলকে, এমন কি আমার স্বামীকেও অনুগ্রহ করে এ ঘর থেকে যেতে বলুন।
হিরণ্ময়ী দেবীর অনুরোধ কিরীটী চোখের ইঙ্গিতে বাকি সকলকে ঘর ছেড়ে যেতে বলল। এবং সকলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
ঘরের মধ্যে রইলাম আমি, কিরীটী ও হিরণ্ময়ী দেবী।
ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা বিরাজ করছে, আর সেই স্তব্ধতার বুক চিরে অদূরে টেবিলের ওপর রক্ষিত টাইমপিসটা কেবল একটানা টিক-টিক শব্দ করে চলেছে।
হিরণ্ময়ী দেবীর অনুরোধে সকলে ঘর ছেড়ে চলে গেলেও কিন্তু কয়েকটা মুহূর্ত হিরণ্ময়ী কোন কথাই বলতে পারলেন না। মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়েছে। স্তব্ধ অনড় পাষাণ-প্রতিমার মত বসে আছেন হিরণ্ময়ী দেবী ইনভ্যালিড চেয়ারটার ওপরে।
সামনেই দুটি চেয়ারে আমি আর কিরীটী বসে। হিরণ্ময়ী একসময় মুখ তুলে কারো দিকে না তাকিয়েই বলতে শুরু করলেন। এবং বলবার সঙ্গে সঙ্গে কোলের উপর থেকে এতক্ষণ পরে উলের বুননটা তুলে নিয়ে দুই হাতে বুনে চললেন।
শিল্পী রণধীর চৌধুরী তাঁর পিতা লক্ষপতি শশাঙ্কশেখর চৌধুরীর একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন। পূর্ববঙ্গে শুধু জমি-জমাই নয়, ব্যাঙ্কেও মজুত ছিল শশাঙ্ক চৌধুরীর লক্ষাধিক টাকা, তিন-চার পুরষ ধরে অর্জিত বিত্ত। শশাঙ্ক ছিলেন যেমনি হিসাবী তেমনি অর্থগৃধ্মু। আর তাঁর একমাত্র ছেলে রণধীর হল ঠিক উল্টো। যেমন খেয়ালী তেমনি দিলদরিয়া স্বভাবের। অল্প বয়সেই শশাঙ্ক চৌধুরীর স্ত্রী জগত্তারিণীর মৃত্যু হয়। লৌকিক ভাবে তিনি আর দ্বিতীয়বার বিবাহ না করলেও তাঁর এক বিধবা শালী জ্ঞানদা তাঁর গৃহে ছিল। তাকে তিনি এনেছিলেন অসুস্থ স্ত্রীর সেবা-শুশ্রষা করতে, কারণ মৃত্যুর আগে বৎসর-চারেক জগত্তারিণী নিদারুণ পক্ষাঘাত রোগে একপ্রকার শয্যাশায়িনী ছিলেন। সেই জ্ঞানদারই গর্ভে জন্ম হল হিরণ্ময়ীর। লোকে হিরণ্ময়ীকে জগত্তারিণীর সন্তান জানলেও আসলে তার জন্ম জ্ঞানদারই গর্ভে। রণধীর আর হিরণ্ময়ী মাত্র তিন বৎসরের ছোট-বড় ছিল এবং রণধীর বহুদিন পর্যন্ত জানতে পারেনি হিরণ্ময়ী তার মায়ের পেটের বোন নয়। জানতে পারে তার পিতার মৃত্যুর পাঁচ মাস আগে। কিন্তু সে-কথা পরে। শশাঙ্ক জীবিতকালেই হিরণ্ময়ীর খুব অল্প বয়সেই হরবিলাসের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে যান। শশাঙ্কর মৃত্যুর সময় হিরণ্ময়ী কাছে ছিলেন না। তবে তাঁর মৃত্যুর মাস-দুই পূর্বে পিতার লিখিত এক চিঠিতে হিরণ্ময়ী জানতে পেরেছিলেন, শশাঙ্ক তাঁর যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি সমান দুই ভাগে রণধীর ও হিরণ্ময়ীকে ভাগ করে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর হিরণ্ময়ী যখন পিতৃগৃহে এলেন এবং কথায় কথায় একদিন পিতার অর্ধেক সম্পত্তির দাবি তুললেন, রণধীর হা-হা করে হেসে উঠলেন।
সম্পত্তি! সম্পত্তি কিসের কী তুই বলছিস হিরু!
ঠিক বলছি। বাবার সম্পত্তিতে আমাদের দুজনের সমান অধিকারই আছে, কারণ
কারণটা বলেই ফেল তাহলে শুনি! কারণ তুমিও যেমন বাবার সন্তান, আমিও তেমনি তাঁর সন্তান।
সন্তান! হ্যাঁ, তা বটে। তবে অবৈধ সন্তান।
দাদা! তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠেন হিরণ্ময়ী দেবী।
হ্যাঁ। আইন বলে, জারজ সন্তানের পিতৃসম্পত্তির ওপরে কোন অধিকার বা দাবিই থাকতে পারে না।
দাদা!
হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। তোমার মা অর্থাৎ আমার বিধবা মাসী-বাবার সঙ্গে তাঁর যা-ই সম্পর্ক থাক, মত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মন্ত্র বা আইনসিদ্ধভাবে বাবা তাঁকে স্ত্রীর মর্যাদা বা অধিকার দেননি এবং তিনি এখনো জীবিত। তাঁকে ডেকে শুধালেই সমস্ত কিছু জানতে পারবে।
রাগে, ঘৃণা লজ্জা ও অপমানে হিরণ্ময়ীর সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে। চেঁচামেচি বা ঝগড়া করবারও উপায় নেই। স্বামী হরবিলাস তখন নীচে। হরবিলাস যদি সব কথা শুনতে পায়, তার বিবাহিত-জীবন সেখানেই শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু তার আগে মা—হ্যাঁ, মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। পাশের ঘরে গেলেন হিরণ্ময়ী। জ্ঞানদা দেবী পাশের ঘরেই ছিলেন। শুভ্র থান-পরিহিতা জ্ঞানদা দাঁড়িয়েছিলেন প্রস্তরমূর্তির মত ঘরের জানালার সামনে। মেয়ে এসে ডাকলে, মাসী! চিরদিন যে ডাকে অভ্যস্ত সেই মাসী ডাকেই ডাকল সে।
জ্ঞানদার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। অবশ্য হিরণ্ময়ীর বুঝতে বাকি ছিল না, পাশের ঘর হতে তার ও রণধীরের ক্ষণপূর্বের কথাবার্তা সমস্তই তাঁর কানে এসেছ। সব কিছুই তিনি শুনেছেন।
মাসী!
এবারে জ্ঞানদা মেয়ের ডাকে ফিরে দাঁড়ালেন।
দুই চক্ষুর কোণ বেয়ে নিঃশব্দ ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সেই পাষাণের মত স্তব্ধ মূর্তি। সেই নিঃশব্দ অশ্রুধারা মুহূর্তে যেন একটা চরম হাহাকারে হিরণ্ময়ীর বুকের মধ্যে এসে আছড়ে পড়ল।
হ্যাঁ হিরণ, সব—সব সত্যি। তুই এই অভাগিনীরই কলঙ্কের ফল। বলতে বলতে জ্ঞানদা দুই হাতে বোধ করি নিজের দুঃসহ লজ্জাটাকে ঢাকবার জন্যই মুখ ঢাকলেন।
হিরণ্ময়ী নির্বাক।
জ্ঞানদা এগিয়ে আসছিলেন দুই হাতে মেয়েকে বুকে নেবার জন্য, কিন্তু পাগলের মত ক্ষিপ্তকন্ঠে চিৎকার করে উঠলেন হিরণ্ময়ী, না, না—তুমি আমায় ছুঁয়ো না। তুমি আমার কেউ নও। আমি তোমার কেউ নই।…কলঙ্কিনি! রাক্ষসী! বলতে বলতে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হড়মড় করে পা পিছলে গড়াতে গড়াতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল হিরণ্ময়ী।