দাঁড়ান!
নারীকণ্ঠ শুনে সকলেই আমরা একসঙ্গে ফিরে তাকালাম।
ইতিমধ্যে কখন একসময় নিঃশব্দে আমাদের পশ্চাতে হিরণ্ময়ী দেবী তাঁর ইনভ্যালিড চেয়ার চালিয়ে নিয়ে এসেছেন তা টেরও পাইনি।
আমার স্বামীকে আরেস্ট করবার আগে আমার কিছু বক্তব্য আছে কিরীটীবাবু! হিরণ্ময়ী দেবী শান্তকণ্ঠে বললেন।
১৫. হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর
হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বরটা যেন মুহূর্তে একটা মোচড় দিয়ে আমাদের সকলের মনই তাঁর দিকে আকর্ষণ করল। তাঁর দু চোখের ব্যগ্র উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি কিরীটীর দু চোখের ওপরে নিবদ্ধ। সমস্ত মুখে একটা গভীর উত্তেজনা যেন থমথম করছে। দুহাতের মুষ্টি যেন উপবিষ্ট ইনভ্যালিড চেয়ারটার হাতল দুটোর ওপরে লৌহ-কঠিন ভাবে চেপে বসে আছে।
কয়েকটা মুহূর্ত কারো কণ্ঠ হতে কোন শব্দ বের হল না। হরবিলাসকে কেন্দ্র করে ক্ষণপূর্বে যে সঙ্কটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, হিরণ্ময়ী দেবীর আকস্মিক আবির্ভাব ও নাটকীয় উক্তি সেটাকে যেন আরো রহস্যঘন করে তুলল। একমাত্র কিরীটী ছাড়া আমরা উপস্থিত সেখানে সকলেই হিরণ্ময় দেবীর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল কিরীটী। পকেট হতে সোনার সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেট দুই ওষ্ঠের বন্ধনীতে চেপে ধরে অগ্নিসংযোগ করবার জন্য ফস করে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালাল। এবং প্রজ্বলিত কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে ফেলে দিতে দিতে শান্ত কণ্ঠে বললে, আপনার কিছু বলবার থাকলে নিশ্চয় আমরা শুনব হিরণ্ময়ী দেবী। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তো শোনা যাবে না। চলুন আপনার ঘরে চলুন!
আমরা সকলে অতঃপর কিরীটীর আহ্বানেই যেন কতকটা হিরণ্ময়ী দেবীর ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।
সেই ঘর। ঠিক তেমনি ভাবে ঘরের সমস্ত জানালাগুলো বন্ধ। ঘরের দেওয়ালে সেই পাশাপাশি দুটি নারীর অয়েল-পেনটিং, দেখলে মনে হয় যেন একই জনের দুটি প্রতিকৃতি। যে ফটো দুটি সম্পর্কে কয়েকদিন পূর্বে কিরীটী হিরণ্ময়ী দেবীকে প্রশ্ন করায় তিনি বলেছিলেন, কার ছবি তিনি জানেন না। এ কথাও মনে পড়ল, তার উত্তরে কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করেছিল ওঁকে, শতদলবাবুর মা হিরণ্ময়ী দেবীর ভাইঝি কিনা? জবাবে হিরণ্ময়ী দেবী বলেছিলেন, হ্যাঁ।
বলুন হিরণ্ময়ী দেবী, আপনার কী বলবার আছে? কিরীটীই বলে হিরণ্ময়ী দেবীকে।
আপনার অনুমান ভুল। আমার স্বামী শতদলকে হত্যা করবার কোন চেষ্টাই করে নি।
কিন্তু আপনার স্বামী যে গত পরশু সকালে বাজারে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে কবিতা দেবীর বাড়িতে গিয়েছিলেন এ কথাও ঠিক, জবাবে বলে কিরীটী।
গত পরশু উনি বাজারে গিয়েছিলেন সত্যি, তবে
হঠাৎ এমন সময় বাধা দিলেন হরবিলাস। এতক্ষণ তিনি চুপ করেই ছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, না হিরণ, চুপ কর। কোন কথাই তোমায় বলতে হবে না। মিঃ ঘোষাল, আপনি আমায় কোথায় নিয়ে যাবেন চলুন, আমি প্রস্তুত!
তুমি থাম, আমাকে বলতে দাও। কতকটা যেন ধমকের সুরেই হিরণয়ী তাঁর স্বামীকে থামিয়ে দিলেন।
কিন্তু আজ হরবিলাস যেন স্ত্রীর কর্তৃত্বে বাধা মানলেন না। জোর গলায় বলে উঠলেন, কেন-কেন মিথ্যে একটা কেলেঙ্কারি করছ হিরণ! যে গেছে সে তো ফিরবে না! চলুন না মিঃ ঘোষাল, কেন দেরি করছেন? চলুন না, কোথায় নিয়ে যাবেন আমায়!
না, না—আমাকে বলতে দাও। পাষাণের মত গুরুভার হয়ে আমার বুকের মধ্যে চেপে বসেছে। এ আর আমি সহ্য করতে পারছি না—আর আমি সহ্য করতে পারছি না, উত্তেজনার আবেগে হিরণ্ময়ী দেবীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল।
হিরণ—হিরণ, চুপ করো—ভুলে যাও। ভুলে যাও ওসব কথা। মিনতিতে করুণ হয়ে ওঠে হরবিলাসের কণ্ঠস্বর।
শুনেন মিঃ রায়, সীতাকে আমি—হ্যাঁ, মা হয়ে আমিই তাকে হত্যা করেছি।
হিরণ—হিরণ! চিৎকার করে ওঠে হরবিলাস কী বলছ তুমি পাগলের মত?
হিরণ্ময়ী দেবীর কথায় ঘরের মধ্যে যেন বজ্রপাত হল। স্তম্ভিত বিস্ময়ে আমরা সকলেই নির্বাক।
হ্যাঁ, আমি। আমিই সীতাকে হত্যা করেছি। আর যে আক্রোশের বশে সীতাকে আমি হত্যা করেছি, সেই আক্রোশের বশেই শতদলকেও আমি হত্যা করতে চেয়েছিলাম। আমার স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ ব্যাপারে তাঁর কোন হাত নেই। অ্যারেস্ট যদি করতে হয় কাউকে, আমাকেই করুন। আমিই দোষী। সমস্ত দোষ আমারই। কান্নায় গলার স্বর বুজে এল হিরণ্ময়ী দেবীর।
না, না—মিঃ রায়, হিরণ নির্দোষ। দোষী আমিই। সীতাকে আমিই হত্যা করেছি। বাধা দিলেন হরবিলাস।
থাম তো তুমি, আমাকে বলতে দাও! চিরাচরিত হিরণ্ময়ী যেন আবার জেগে উঠলেন। সেই আধিপত্যলোভী নারী। নিজস্ব স্বকীয়তায়, নিজস্ব অহমিকায়। স্ত্রীর তর্জনে হরবিলাস একেবারে ঝিমিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত আগেকার তাঁর কষ্টার্জিত পৌরষ যেন একটিমাত্র তর্জনে ভেঙে চুপসে গেল। তবু, শেষবারের মত বুঝি স্ত্রীকে নিরস্ত করবার চেষ্টায় ক্ষীণ মিনতিভরা কণ্ঠে বললেন, যা চুকেবুকে গিয়েছে, সেই অতীতকে দিনের আলোয় টেনে এনে কী লাভ আর হিরণ!
না, আমাদের যদি শাস্তি পেতেই হয়, সব কথাই বলে যাব। কারণ আমি জানি, এখানে এমন একজন আছেন যাঁর দৃষ্টির সামনে সত্যকে একটা আবরণ দিয়ে কেউ ঢেকে রাখতে পারবে না, বলতে বলতে হিরণ্ময়ী দেবী বারেকের জন্য কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।