দেখবার ভুল! আপনি বলছেন দেখবার ভুল? রসময় ঘোষালের স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে যেন এবারে একটা পলিসী কাঠিন্য ফুটে ওঠে।
তা ছাড়া আর কী বলি বলুন! চারদিন পায়ের যন্ত্রণায় পায়ের পাতা ফেলতে পারি নি, নিজে বসে হট ফোমেন্টশন দিয়েছি—আজই সবেমাত্র একটু যা হাঁটা-চলা শুরু করেছি। আর আপনি কিনা দেখলেন আমায় বাজারে!
হরবিলাসবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার মিথ্যা চেষ্টা করছেন! পনের বছর এই পুলিশ লাইনে চাকরি করছি। অত সহজে আমাদের দৃষ্টিভ্রম হয় না। আপনি সাপ নিয়ে খেলা করছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গতকাল হঠাৎ নার্সিং হোমে শতদলবাবু কড়াপাকের সন্দেশ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন
মুহূর্তে যেন রসময় ঘোষালের কথাটা শুনে হরবিলাসের কৌতুকোভাসিত উজ্জল মুখখানা নিষ্প্রভ হয়ে গেল। হরবিলাসের মুখের চেহারার হঠাৎ পরিবর্তন আমার দৃষ্টিতেও এড়ায় না, কিন্তু হরবিলাস ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। মৃদু উৎকণ্ঠামিশ্রিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তাই নাকি? সন্দেশ খেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন?
কারণ সে সন্দেশের মধ্যে বিষ ছিল!
বিষ! একটা আর্ত শব্দের মতই হরবিলাসের কণ্ঠ হতে কথাটা উচ্চারিত হল।
হ্যাঁ, বিষ। মরফিন।
হরবিলাস স্থির অচঞ্চল দৃষ্টিতে কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ঘোষালের মুখের দিকে।
রসময় ঘোষালের তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিও হরবিলাসের দুটি চোখের প্রতি অপলক হয়ে আছে। চারজোড়া চোখের দৃষ্টি যেন পরস্পরকে লেহন করছে।
আপনি কী বলতে চান ঘোষাল সাহেব?
শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে লাল গোলাপ ও কড়াপাকের সন্দেশ পাঠাতে হবে, আপনিই কবিতা দেবীকে অনুরোধটা জানিয়ে এসেছিলেন গত পরশু কোন এক সময়, তাই নয় কি?
একেবারে স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের ওপরে অভিযোগ। একেবারে সম্মুখযুদ্ধে আহ্বান। আবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য কঠিন স্তব্ধতা।
ওঃ, আপনি এতক্ষণ ধরে তাহলে এই কথাটাই আমাকে বলতে চাইছিলেন ঘোষাল সাহেব! হরবিলাসের শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠস্বরে যেন একটা অস্পষ্ট ব্যঙ্গের হুল উদ্যত হয়ে ওঠে।
রসময় কোন জবাব দেন না। কেবল স্থিরদৃষ্টিতে ঘোষালের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
আপনার অনুমান তাহলে আমিই শতদলকে সন্দেশের মধ্যে বিষ দিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিলাম? হরবিলাসই দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ। যতক্ষণ না বলছেন কেন আপনি গত পরশু সকালে বাজারে গিয়েছিলেন এবং ওষুধের দোকানে ঢুকেছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমি সন্দেহ করব।
কিন্তু শতদলকে মেরে আমার লাভ কী ঘোষাল সাহেব?
মারবার কথা তো এর মধ্যে উঠছে না হরবিলাসবাবু! এতক্ষণে কিরীটী কথা বলে, আপনার ঐ সময়ে সেদিন বাজারে উপস্থিতিটাই ওঁর মনে সন্দেহ আনছে কতকগুলো ব্যাপারে।
কিন্তু সেইটাই তো মিথ্যা!
মিথ্যা নয়। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন বজ্রের মত ধ্বনিত হল, উনি ঠিকই বলেছেন।
তার মানে? মিনমিনে গলায় হরবিলাস কথাটা বললেন।
আপনার ডান হাতের আংটির প্রবাল পাথরটা কই? প্রবাল পাথর! বিস্ময়ে যেন স্তম্ভিত হরবিলাস।
হ্যাঁ, প্রবালটা! কোথায় সেটা? দেখুন তো হাতের আঙুলের আংটিটা আপনার!
তাই তো! পাথরটা? চোখের সামনে ডান হাতটা তুলে আংটিটার দিকে তাকালেন হরবিলাস।
সত্যি হরবিলাসের হাতের আঙুলের আংটিটার পাথরটা নেই!
লক্ষ্যও করেননি হরবিলাসবাবু; যে, আংটির পাথরটা আপনি ইতিমধ্যে হারিয়েছেন! যাক, এই নিন পাথরটা বলতে বলতে কিরীটী জামার পকেটে হাত চালিয়ে একটি বড় মটরের দানার মত প্রবাল পাথর বের করে হাতের পাতায় পাথরটা নিয়ে এগিয়ে ধরলে হরবিলাসের সামনে। দেখুন এটাই আপনার অজ্ঞাত হারানো প্রবাল। দেখুন ঠিক আংটিটায় বসে যাবে।
সত্যি হরবিলাসেরই আংটির পাথর সেটা।
সকলেই আমরা বিস্মিত ও নির্বাক। অকস্মাৎ অন্ধকার কক্ষের মধ্যে যেন রৌদ্রালোক এসে পড়েছে। কিরীটী আবার বলে, পাথরটা আজই সকালে শরৎবাবু উকিলের বাসার বৈঠকখানায় কুড়িয়ে পেয়েছি হরবিলাসবাবু। একটু আগে রসময়বাবু, যখন আপনাকে গত পরশু সকালে বাজারে দেখেছেন বলে জেরা করছিলেন, হঠাৎ আপনার হাতের আঙুলের আংটিটার প্রতি আমার নজর পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয়, এই পাথরটাই ইতিপূর্বে আপনার আঙুলের আংটিতে বসানো আমি দেখেছি। একেবারে সাধারণ যোগ-দুয়ে দুয়ে চার। এখন আর নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না হরবিলাসবাবু, যে আপনি এতক্ষণ যা বলছিলেন তা সত্য নয়!
হরবিলাস একেবারে নির্বাক। স্তব্ধ নিশ্চল। প্রাণহীন পাষাণমূর্তির মত দাঁড়িয়ে।
এবারে বলতে বাধা নেই নিশ্চয়ই হরবিলাসবাবু, কেন গত পরশু সকালে আপনি বাজারে গিয়েছিলেন আর কেনই বা কবিতা দেবীর বাড়িতে গিয়ে শতদলকে ফুল ও সন্দেশ পাঠাবার জন্য বলে এসেছিলেন! ঝাঁজিয়ে উঠলেন ব্যঙ্গে রসময় ঘোষাল।
কিন্তু নির্বাক হরবিলাস। টু শব্দটি বের হয় না মুখ দিয়ে।
কী, চুপ করে কেন? জবাব দিন?
আমার কিছুই বলবার নেই দারোগা সাহেব। আপনার যা খুশি করতে পারেন।
আমার প্রশ্নের আপনি জবাব দেবেন না?
না।
বেশ, তাহলে শতদলবাবুকে সন্দেশের মধ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করবার প্রচেষ্টার জন্য আপনাকে আমি আরেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি। কান সিং!
বেশ, আপনার যেমন অভিরুচি। বললেন শান্তভাবে হরবিলাস। কান সিং এগিয়ে এল জুতোর মচমচ শব্দ তুলে। বাবুকে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতঘরে রাখ। রসময় বললেন।