শরৎবাবু উকিলের বাসায় তাঁর মেয়ে কবিতা গুহর সঙ্গে দেখা করতে।
হঠাৎ?
নার্সিং হোমে ফুল-সন্দেশ তারই পরামর্শমত শতদলবাবুকে রাণু দেবী পাঠিয়েছিলেন!
তার মানে? বিস্মিত রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
তার মানে ঐটাই সব ও শেষ নয়। ওটা তো প্রদীপের আলো। আলো জ্বালাবার ইতিহাস আরো পশ্চাতে। সে আর এক ভগ্নদূত-সংবাদ! কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দেয়।
ভগ্নদূত-সংবাদটি আবার কী!
কে এক খোঁড়া দূত শতদলবাবুরে পরিচিত কবিতা দেবীকে এসে জানায়, শতদলবাবু নাকি অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন তাঁকে যেন কিছু লাল গোলাপ নার্সিং হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণেই হোক, কবিতা দেবী নিজে ফুলটা না পাঠিয়ে ফুলগুলো রাণু দেবীকে পাঠিয়ে দিতে অনুরোধ জানায়। রাণু দেবী সেই ফুলই শুধু নয়—ঐ সঙ্গে মিষ্টি যোগ করে দেন, অর্থাৎ কিছু; কড়াপাকের সন্দেশ দিয়ে আসেন।
ঐ হোটেলের বেয়ারাদের মধ্যেই তাহলে কেউ একজন সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোষাল সাহেব, জল সেখানেও গভীর। অনুসন্ধানে জেনেছি রামকানাই নামে এক বেয়ারাই সন্দেশ কিনে এনে দিয়েছিল এবং রাণু দেবী স্বয়ং সন্দেশ ও ফুল নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসেন।
রাণু দেবীকে আপনি ঐ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করেননি?
সুব্রতই গতরাত্রে করেছিল। দু-একটা আমিও করেছি, কিন্তু যে মৎস্যটি গভীর জলে থেকে ল্যাজের ঝাপটা মেরেছেন, সে তো রাণু দেবী নন! রাণু দেবীর বুদ্ধি ও চিন্তারও অগোচরে। কিন্তু তিনি যত গভীরেই থাকুন, তাঁর ল্যাজের আঁশ আমার চোখে পড়েছে।
বলেন কী! কাউকে সন্দেহ–
হ্যাঁ, অন্ধকারে আলো দেখতে পাওয়া গিয়েছে ঘোষাল সাহেব। কিন্তু মাত্র একটি জায়গায় সূত্র এসে একটা জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে।
কিরীটীর কথায় বিস্মিত আমিও কম হইনি। কিরীটী তাহলে সমাধানে প্রায় পৌঁছে গিয়েছে! নিরালা-রহস্য মীমাংসার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে!
বলতে বলতে কিরীটী থেমে গিয়েছিল। যতটুকু কিরীটী এইমাত্র বললে, তার চাইতে একটি কথাও বেশী এখন আর সে বলবে না, এও আমার জানা। তাই সে ঐ পর্যন্ত বলে থেমে গেল, কিন্তু কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে রসময় ঘোষালের সম্যক পরিচয় নেই, তাই তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, লোকটি কে?
দু-একদিনের মধ্যেই জানতে পারবেন! গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটীর সংক্ষিপ্ত জবাব শোনা গেল।
ইতিমধ্যে আমরা আমাদের গন্তব্য স্থান নিরালার গেটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেই দিকেই কিরীটী রসময়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে, চলুন দেখা যাক নিরালা কী বলে!
দরজা বন্ধ ছিল।
বন্ধ দরজার একপাশে দরজা খোলবার জন্য ভিতরে সাংকেতিক ঘণ্টার সঙ্গে ঝুলন্ত সংযুক্ত দড়িটার প্রান্ত ধরে কিরীটী বার-দুই টান দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। খোলা দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে হরবিলাস।
আসুন। হরবিলাস আমাদের আহ্বান জানালেন।
হরবিলাস এগিয়ে চললেন, পশ্চাতে রসময় ঘোষাল, আমি ও কিরীটী। সর্বশেষে সঙ্গের সেই কনস্টেবলটি।
সীতার মত্যুর প্রায় পাঁচদিন পরে নিরালায় এসে আমরা প্রবেশ করলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল, হরবিলাস যেন ডান পা-টা একটু টেনে টেনে চলেছেন মন্থর ভাবে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনলাম।
ডান পায়ে আপনার কী হল হরবিলাসবাবু?
চলতে চলতেই হরবিলাস জবাব দিলেন, কয়েক দিন আগে বাগানে কাজ করবার সময় পায়ে একটা কাঁটা ফুটেছিল। সেটাই পেকে গিয়ে নচেৎ নিজেই আপনাদের কাছে যেতাম।
কাঁটা ফুটেছিল! কিরীটী পালটা প্রশ্ন করে।
কিরীটীর প্রশ্নের জবাবে হরবিলাস কী জবাব দিতেন জানি না, কিন্তু জবাব দেবার পূর্বেই কথা বললেন রসময় ঘোষাল।
কদিন বাড়ি থেকে তাহলে বের হননি বলুন!
না, মেয়েটা বুকটা একেবারে ভেঙে দিয়ে গিয়েছে। অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল হরবিলাসের কণ্ঠস্বর।
কিন্তু আপনি মিথ্যা কথা বলছেন হরবিলাসবাবু! কঠিন কণ্ঠে বললেন এবারে রসময় ঘোষাল কথাগুলো।
মিথ্যা কথা বলছি! প্রশ্নটা যেন পালটা উচ্চারণ করে ঘুরে দাঁড়ালেন হরবিলাস রসময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।
চোখ দুটো তাঁর অদ্ভুত একটা দীপ্তিতে ঝকঝক করছে কিসের এক প্রত্যাশায়।
আমরাও নির্বাক।
হ্যাঁ, মিথ্যা বলেছেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি, কারণ পরশু সকালে বাজারে একটা ওষুধের দোকানের সামনে আপনাকে আমি দেখেছি। দোকান থেকে আপনি বের হয়ে আসছেন, হাতে আপনার একটা প্যাকেট ছিল।
ক্ষণপূর্বে যে বিস্ময় ও চাপা একটা ক্রোধ হরবিলাসের মুখখানার ওপরে থমথমে হয়ে উঠেছিল, মুহূর্তে যেন সেটা মেঘমুক্ত চাঁদের মত নির্মল হাস্যদীপ্তিতে ঝলমল করে উঠল। স্মিতকণ্ঠে হরবিলাস এবারে বললেন, ভুল দেখেছেন দারোগা সাহেব! আমি নয়—এই পাঁচদিন বাড়ি থেকে এক পা-ও আমি বের হইনি কোথাও!
স্পষ্ট দিনের আলোয় স্পষ্টই দেখেছি হরবিলাসবাবু! ভুল হতে পারে না।
পারে বৈকি। ভুল তো আমরা কত সময়েই করি। বিশেষ করে দেখার ভুল-দেখবার ভুল!
হরবিলাসের শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয়, যেন কোন একটি শিশুকে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে কিছু বোঝাচ্ছেন। কিরীটীর দিকে একবার বক্রদৃষ্টিতে না তাকিয়ে পারলাম না। কিন্তু সে-মুখ যেন পাষাণে কুঁদে তোলা। কোথায়ও এতটুকুও উত্তেজনা বা দীপ্তিমাত্রও নেই। এতটকু আগ্রহের চিহ্ন পর্যন্তও যেন ওর মুখের ভাবে চোখের দৃষ্টিতে নেই।