কিরীটী আর আমি তখন শতদলের সঙ্গে দেখা করলাম।
তাকে প্রশ্ন করায় সে বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। বললে, সে কি! সন্দেশ কড়াপাকের আমি খেতে ভালবাসি সত্য এবং লাল গোলাপও আমার খুব প্রিয়, কিন্তু মনের অবস্থা কদিন ধরে আমার এমন চলছে যে, ওসব তুচ্ছ কথা ভাববারই অবকাশ পাইনি!
নার্সিং হোম হতে বিদায় নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে, মনের মধ্যে কিছুটা হতাশা ও ঘনীভূত একটা বিস্ময় নিয়েই।
হোটেলে আমাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য যে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। তা বুঝতে পারিনি। হোটেলের বারান্দায় উঠতেই দেখি, থানার দারোগা রসময় ঘোষাল আমাদের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে বসে আছেন। আমাদের দেখেই রসময় বললেন, এই যে কিরীটীবাবু, কোথায় ছিলেন? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি!
ব্যাপার কী? কিরীটী প্রশ্ন করে।
কাল রাত্রে যে নিরালায় চোর এসেছিল!
নিরালায় চোর এসেছিল?
হ্যাঁ, স্টুডিও-ঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল—
কিরীটী কথাটা শুনে যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে ওঠে, কী বললেন, স্টুডিও-ঘরে চোর ঢুকেছিল?
হ্যাঁ। কিছু চুরি গিয়েছে জানেন?
তা তো বলতে পরি না, তবে অবিনাশের হাত দিয়ে হরবিলাস ঘোষ চিঠি পাঠিয়েছেন। এই সেই চিঠি।
রসময় ঘোষাল একটা চিঠি কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন।
১৪. থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল
কিরীটী হাত বাড়িয়ে থানা-অফিসার রসময় ঘোষালের প্রসারিত হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল।
আমিও কৌতুহল দমন করতে না পেরে পশ্চাৎ দিক হতে ঝুঁকে কিরীটীর হস্তধৃত খোলা চিঠিটায় দৃষ্টিপাত করলাম।
সংক্ষিপ্ত চিঠি। হরবিলাস ঘোষ লিখেছেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষালকে সম্বোধন করে।
থানা ইনচাজ শ্রীরসময় ঘোষাল সমীপেষু,
সবিনয় নিবেদন, দারোগাবাবু, আপনাকে জানানো কর্তব্য বলিয়া জানাইতেছি—গতকাল
রাত্রে ‘নিরালা’য় চোর আসিয়াছিল এবং চোর কিছু চুরি করিয়া গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না;
তবে দ্বিতলের স্টুডিও-ঘরের ও শতদলের ঘরের তালা দুটি ভগ্ন অবস্থায় দরজার কড়ার সঙ্গে
ঝুলিতেছে দেখিতে পাই এবং উভয় ঘরের দরজাই খোলা ছিল। শতদলের ঘর হইতে কোন
মূল্যবান কিছু চুরি গিয়াছে কিনা বলিতে পারি না। কারণ ইতিপূর্বে তার ঘরে আমি প্রবেশ করি
নাই এবং সে-ঘরে তাহার মূল্যবান কিছু ছিল কিনা বলিতে পারি না। যাহা হউক, এ ব্যাপারে
কোন কিছু করণীয় থাকিলে করিতে পারেন। আর একটা কথা—এই সপ্তাহের শেষেই আমি ও
আমার স্ত্রী এখান হইতে চলিয়া যাইতে চাই। নমস্কার।
ইতিঃ হরবিলাস ঘোষ
কিরীটী চিঠিটা একবার মাত্র পড়ে রসময় ঘোষালের হাতে প্রত্যর্পণ করল।
চিঠিটা হাতে নিয়ে রসময় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, যাবেন নাকি একবার নিরালায়?
হ্যাঁ, যেতে হবে বৈকি। চলুন, এখুনি না হয় একবার ঘুরে আসা যাক!
এখুনি যাবেন?
হ্যাঁ-না, আর একটু দেরি করাই ভাল।
রাণুও এতক্ষণ আমাদের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে এবারে মন্থর পায়ে উপরের সিঁড়ির দিকে চলে গেল।
আমরা তো প্রস্তুত হয়েই ছিলাম সকলে নিরালায় যাবার জন্য। রাস্তায় নেমে সমুদ্রকিনারের পথ ধরে পাহাড়ের দিকে চলতে শুরু করলাম। রসময় ঘোষালের সঙ্গে যে লাল পাগড়ি এসেছিল সেও আমাদের অনুসরণ করে। শীতের রোদ আরামদায়ক হলেও এখনো বেশ কনকনে। কষ্টকর মনে হয়। বেলা প্রায় পৌনে এগারোটা হবে।
এখনো সমুদ্রে স্নানার্থীদের ভিড় কমেনি। বহু পুরুষ-নারী বালকবালিকা যুবক-যুবতী হৈ-চৈ করে সমুদ্রের জলে লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপি করছে। তাদের উল্লাস কানে আসে। নিঃশব্দে কিরীটী ও রসময় ঘোষাল পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। ওদের পশ্চাতে আমি। নিরালায় স্টুডিও-ঘরে বা শতদলের ঘরে এমন কী ছিল যার জন্য কাল রাত্রে চোরের আবির্ভাব হল! শতদলের ঘরে তবু কিছু থাকতে পারে, কিন্তু স্টুডিও-ঘরে কেবল কতকগুলো ছবি আর স্ট্যাচু! খেয়ালী ধনী আর্টিস্টের বাড়ি—স্টুডিও-ঘরের মধ্যে কোন গুপ্ত কক্ষ বা আলমারি বা চোরা জায়গা ছিল না তো? ছিল না তো তার মধ্যে এমন কোন মূল্যবান বস্তু, যার জন্য চোরের উপদ্রব হয়েছিল গতরাত্রে? ইতিপূর্বেও রাত্রে নিরালায় যার আবির্ভাব ঘটেছিল একবার, সে শতদলের প্রাণহরণের চেষ্টা করেছিল এবং দ্বিতীয়বারের উদ্দেশ্যটা ঠিক পরিস্ফুট না হলেও সীতার কুকুরটাকে জখম করে গিয়েছিল!
হঠাৎ আবার সীতার কথা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে।
সীতা!
মনে হয় সে বুঝি মরেনি। নিষ্ঠুরভাবে অদৃশ্য আততায়ীর হাতে পিস্তলের বুলেটে নিহত হয়নি। সে যেন এখনো মনে হয় নিরালাতেই আছে। এই যাচ্ছি—গেলেই দেখা হবে! শ্যামাঙ্গী অপরাজিতার মত ঢলঢলে মেয়েটি। স্মৃতির পাতাগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে।
মরে গিয়েছে– চোখের সামনে তার রক্তাক্ত মৃতদেহটা অসাড় অসহায় অবস্থায় ঘরের মেঝের ওপরে কার্পেটে আমরা সকলেই পড়ে থাকতে দেখেছি। মৃতদেহের অবস্থায়—ভিতর থেকে রিভলভারের বুলেটও পাওয়া গিয়েছে, তবু মনে হচ্ছে মরেনি সে, এখনো বেঁচে আছে!
কেন এমন হয়?
কিন্তু কে অমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলে মেয়েটিকে, আর কী উদ্দেশ্যেই বা হত্যা করলে? সীতার কুকুর টাইগার যে-রাত্রে জখম হয়, সে-রাত্রেও আততায়ী সীতাকে হত্যা করবার চেষ্টা করেছিল। আচমকা কুকুরটা সামনে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তাকেই জখম করে পালিয়ে যায়। হঠাৎ রসময়ের কথা কানে এল, রসময় কিরীটীকে প্রশ্ন করছেন, সক্কালবেলাতেই কোথায় গিয়েছিলেন মিঃ রায়?