কিরীটী আবার উপরে চলে গেল। মিনিট পনের বাদে কিরীটী ফিরে এল।
***
হোটেলে ফিরে এলাম। ডাক্তারের টমটমই আমাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে গেল।
কিরীটীর পকেটে যে নীল লেটার-প্যাডের কাগজে লেখা চিঠিটা ছিল, আমার মনের মধ্যে সবটুকু সেটাই অধিকার করে ছিল। চিঠিটা সম্পর্কে কিরীটী আর কোন উচ্চবাচ্য করলেও আমি কিন্তু চিঠিটার কথা কোনমতেই ভুলতে পারছিলাম না। আশা করেছিলাম, হোটেলে ফিরেই কিরীটী রাণুকে ডেকে নিশ্চয়ই চিঠিটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবে কিন্তু কিরীটী সেদিক দিয়েই গেল না। সোজা ঘরে ঢুকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমি বাইরের বারান্দায় একটা আরামকেদারার উপরে গা এলিয়ে দিলাম।
শীতের ঘনায়মান সন্ধ্যায় চারিদিক অস্পষ্ট। একটানা সমুদ্রগর্জন দূরের সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্য হতে কানে এসে প্রবেশ করছে। ইতিমধ্যেই হোটেলের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে।
কতক্ষণ অন্ধকারে চেয়ারটার ওপরে বসেছিলাম মনে নেই, হঠাৎ রাণুর কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙল।
কে, সুব্রতবাবু নাকি?
কে–ও মিস মিত্র!
অন্ধকারে চুপটি করে বসে আছেন যে?
না, এমনিই। বসুন।
রাণু পাশের চেয়ারটায় বসল।
উঃ, আজ অনেক ঘুরেছি। একা একা বেড়াতে যাব না বলে আপনাদের খুঁজতে এসেছিলাম। বেয়ারাটা বললে, বিকেলের দিকে টমটম করে আপনি আর মিঃ রায় শহরের দিকে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছিলেন? রাণু, জিজ্ঞাসা করে।
ডক্টর চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমে।
শতদল কেমন আছে? বেচারা একটু সামলাতে পেরেছে কি?
হ্যাঁ। অদম্য কৌতূহলটাকে আর নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম আপনি তো আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন রাণু দেবী শতদলবাবুকে!
হ্যাঁ, পেয়েছে?
শান্তকণ্ঠে উচ্চারিত রাণুর কথাটা যেন মুহর্তে একটা বৈদ্যুতিক তরঙ্গাঘাতে আমাকে একেবারে বিবশ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত আমার যেন বাক্যস্ফূর্তি হল না। আমি বোবা হয়ে গিয়েছি। অন্ধকারেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম রাণুর মুখের দিকে, কিন্তু অন্ধকারে রাণুর মুখখানা অস্পষ্ট একটা ছায়ার মত মনে হয়।
আপনিই তাহলে শতদলবাবুকে আজ ফুল আর মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, কিন্তু কেন বলুন তো? উৎকণ্ঠা-মিশ্রিত কণ্ঠে রাণু, প্রশ্ন করে।
সেই সন্দেশ খেয়ে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন!
বলেন কি?
হ্যাঁ, ডক্টর চ্যাটার্জীর ধারণা সেই সন্দেশের মধ্যে মরফিন ছিল।
মরফিন! কী বলছেন যা-তা সুব্রতবাবু!
বললাম তো, ডাক্তারের তাই বিশ্বাস। সন্দেশ আপনি কি নিজে হাতে কিনেছিলেন?
না।
তবে?
সন্দেশ হোটেলের বেয়ারাকে দিয়ে কিনিয়ে আনিয়েছিলাম।
আর ফুলগুলো? অকস্মাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বর, শুনে আমি ও রাণু দুজনেই যুগপৎ পশ্চাতের অন্ধকারে ফিরে তাকালাম।
ইতিমধ্যে আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে কখন যে কিরীটী পশ্চাতের অন্ধকারে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে এবং আমাদের পরস্পরের কথোপকথন শুনেছে, তার বিন্দুমাত্র টের পাইনি। কয়েকটা মুহূর্ত আমরা দুজনেই চুপ করে থাকি। কিরীটী দ্বিতীয়বার আবার প্রশ্ন করে, আর গোলাপ ফুলগুলো?
ওগুলো শরৎবাবুর মেয়ে মিস কবিতা গুহ পাঠিয়েছিলেন।
মিস গুহ—মানে সে-রাত্রে নিরালায় যার সঙ্গে আলাপ হল? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
কবিতা গুহর সঙ্গে কি শতদলবাবুর পূর্ব-পরিচয় ছিল?
কবিতা আমার ক্লাস-ফ্রেণ্ড। শতদলের সঙ্গে কবিতার আমাদের বাড়িতেই আলাপ হয়।
হুঁ।
পরের দিন প্রত্যুষে আমি ও কিরীটী রাণুকে সঙ্গে নিকে কবিতা গুহর বাসায় গেলাম।
কবিতা ভিতরে ছিল। রাণুকে পাঠানো হল তাকে ডেকে আনবার জন্য। কিরীটী অবশ্য রাণুকে নিষেধ করে দিয়েছিল, পূর্বাহ্নে কবিতাকে কোন কথা না বলতে।
একটু পরেই রাণুর সঙ্গে কবিতা বাইরের ঘরে এল। শরৎ উকিল ঐ সময় বাসায় না থাকায় আমাদের কথাবার্তা বলবার বিশেষ সুবিধাই হল।
দু-চারটে মামুলী কথাবার্তার পর কিরীটী ফুলের প্রসঙ্গে এল।
আপনি কাল শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে গোলাপফুল পাঠিয়েছিলেন কবিতা দেবী?
হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে শতদলবাবুর কাছ হতে কাল সকালে একজন লোক এসে বললে, শতদলবাবু কিছু ফুল পাঠাতে বলেছেন—আমাদের বাগানের গোলাপ। এ-ও সে বলেছিল, ফুলগুলো যেন আমি রাণুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিই। তাই–
আশ্চর্য! লোকটা কী রকম দেখতে বল তো কবিতা? কথাটা বললে রাণু।
এখানকার স্থানীয় লোক বলেই মনে হয়। বোধ হয় নার্সিং হোমেই কাজ করে। কবিতা জবাব দেয়, কালো ঢ্যাঙা লম্বা মত। একটু খুঁড়িয়ে চলে।
Exactly! সেই লোকটা কাল সকালে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা করে বলে, শতদলবাবু কিছু কড়াপাকের সন্দেশ তাঁকে পাঠাতে বলেছেন। কথাগুলো বললে রাণু।
এবারে কথা বললে কিরীটী, রাণু, ও কবিতা দুজনকেই সম্বোধন করে, তাহলে আপনারা দুজনেই সেই লোকটির মুখে সংবাদ পেয়েই ফুল আর মিষ্টি নার্সিং হোমে পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। দুজনেই একসঙ্গে জবাব দেয়।
বলাই বাহুল্য, অতঃপর শরৎ উকিলের বাসা থেকে সোজা আমরা রাণুকে নিয়েই নার্সিং হোমে গেলাম। এবং ডাক্তার চ্যাটার্জীকে সব বলে কিরীটী ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলে, কবিতা ও রাণু, বর্ণিত ঐ ধরনের বা চেহারার কোন লোক নার্সিং হোমে আছে কিনা!
ডাক্তার শুনে তো বিস্মিত, কই, ও-ধরনের চেহারার কোন লোকই তো আমার এখানে কাজ করে না! চারজন সুইপার, দুজন দারোয়ান ও দুজন কুক। তাদের ডাকা হল, কিন্তু রাণু, বললে, ওদের মধ্যে কেউ নয়।