কেবিনে শতদলবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে আপনি বোধ হয় ডক্টর চ্যাটার্জীকে সংবাদ পাঠান?
হ্যাঁ, সে সময় আমিই ঘরে ছিলাম। মৃদুকণ্ঠে জবাব এল।
কিরীটী হঠাৎ সোজা হয়ে বসল, আপনি সেই সময় শতদলবাবুর কেবিনের মধ্যেই উপস্থিত ছিলেন?
হ্যাঁ।
আগে থাকতেই আপনি কেবিনের মধ্যে ছিলেন, না ঠিক ঐ সময়টিতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন?
ওঁর সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। সরলা আমাকে কিছু গোলাপ ফুল, একটা চিঠি ও একবাক্স মিষ্টি এনে দেয় শতদলবাবুকে দেবার জন্য। সেগুলো নিয়ে কেবিনে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উনি আমাকে কথায় কথায় আটকে রেখেছিলেন।
আপনার সামনেই তাহলে শতদলবাবু মিষ্টি খান?
হ্যাঁ।
মিসেস মহান্তি, যদি কিছু মনে না করেন তো in details আজকের ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন!
জিনিসগুলো নিয়ে শতদলবাবুর কেবিনে ঢুকতেই তিনি প্রশ্ন করলেন, ওগুলো কী? আমি জিনিসগুলো তাঁর হাতে দিয়ে সব বললাম। তারপর বেরিয়ে আসতে যাব, শতদলবাবু আমাকে ডেকে বললেন, সিস্টার, ঐ ভাসে এই ফুলগুলো একটু সাজিয়ে দিন না, please! ভাসের ফুল যা ছিল সেগুলো তুলে নিয়ে গোলাপ ফুলগুলো সাজিয়ে দিচ্ছিলাম যখন, শতদলবাবু সে-সময় চিঠিটি পড়ছিলেন। তারপরই মিষ্টির বাক্সটা খুলে বললেন, How lovely! কড়াপাকের সন্দেশ! বলতে বলতেই গোটা-দুই সন্দেশ মুখে পুরে দিলেন। এবং আমাকে বললেন একগ্লাস জল দিতে। ঘরের কোণায় কুজোতে জল ছিল। গ্লাসে জল ভরে তাঁর সামনে নিয়ে দাঁড়াতেই দেখি, শতদলবাবুর সমস্ত চোখেমুখে যেন একটা আতঙ্ক। কোনমতে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললেন, সিস্টার, শীগগির ডক্টর চ্যাটার্জীকে খবর দিন। আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি। Quick! যান। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় ছুটে গিয়ে ডক্টর চ্যাটার্জীকে ডেকে আনি।
সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী নিশ্চলভাবে বসে মিসেস মহান্তি বর্ণিত কাহিনী শুনছিল, হঠাৎ যেন তার নিশ্চল দেহটা একটা বিদ্যুৎস্পর্শে সজাগ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কিরীটীর ক্ষণপূর্বের স্তিমিত চোখের তারা দুটো যেন আচমকা বিদ্যুৎ-শিখার মত জলে উঠল। ঝকঝক করে উঠলো ধারালো ছুরির ফলার মত। কিরীটীর ঐ দৃষ্টিকে আমি চিনি। সহসা উপবিষ্ট কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করে। দু-চার মিনিট কেটে গেল একটা অখণ্ড নিস্তব্ধতার মধ্যে। ঘরের আমরা বাকি তিনজন নির্বাক হয়ে আছি। আমি আর ডক্টর চ্যাটার্জী উপবিষ্ট। মিসেস মহান্তি আমাদের সামনেই দণ্ডায়মান।
হঠাৎ আবার কিরীটীই ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডক্টর, এবারে আমরা শতদলবাবুকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি কি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। চলুন।
সকলে আমরা কেবিনে এসে প্রবেশ করলাম।
চক্ষু দুটি মুদ্রিত। শতদলবাবু শয্যার ওপরে শুয়েছিলেন। আমাদের পদশব্দে চোখ মেলে তাকালেন। ডাঃ চ্যাটার্জীই সর্বপ্রথমে এগিয়ে গিয়ে শতদলের পালসটা দেখলেন, এখন বেশ সুস্থ বোধ করছেন তো শতদলবাবু?
হ্যাঁ, ধন্যবাদ। অতঃপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি কখন এলেন মিঃ রায়?
এই তো কিছুক্ষণ হল।
ডক্টর চ্যাটার্জীর মুখে সব শুনেছেন বোধ হয়! There was another attempt! স্মিতকণ্ঠে শতদল বললে।
হ্যাঁ, শুনলাম। ভয় পাবেন না মিঃ বোস—this is last! কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা।
আর কারো কানে সেটুকু না ধরা পড়লেও আমার শ্রবণেন্দ্রিয়কে সেটা ফাঁকি দিতে পারে না।
সত্যি! ভাবতেই পারিনি সন্দেশের মধ্যে
শতদলকে বাধা দিয়ে কিরীটী বললে, কে আপনাকে ফুল ও মিষ্টি পাঠিয়েছিল শতদলবাবু?
সত্যি কথা বলতে কি, মিঃ রায়, এতক্ষণে শুয়ে শুয়ে সেইটাই ভাবছিলাম। আপনিও তাকে চেনেন– রাণু!
বজ্রের মতই যেন দু-অক্ষরের নামটি আমার কর্ণে ধ্বনিত হল, রাণু!
কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও কম বিস্মিত হয়নি। এবং কণ্ঠস্বরেও তার সে বিস্ময়টুকু ধ্বনিত হয়ে উঠল, রাণু দেবী!
হ্যাঁ। এই দেখুন না চিঠি, বলে শয্যার আশেপাশে চিঠিটা খুজতে থাকে শতদল চিঠি চিঠিটা গেল কোথায়
মিসেস মহান্তি এমন সময় এগিয়ে এলেন এবং বালিশের তলা থেকে নীল খাম সমেত খোলা চিঠিখানা বের করে শতদলের হাতে তুলে দিলেন, এই যে!
কিরীটী চিঠিটা শতদলের হাত থেকে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। আমিও আরো এগিয়ে গেলাম। নীল রঙের পর, লেটার-পেপারে রয়েল ব্লু কালিতে লেখা চিঠি।
মুক্তোর মতো ঝরঝরে পরিষ্কার হাতের গোটা অক্ষর। এবং হাতের লেখা দেখলে কোন পুরুষের নয়—মেয়ের বলেই মনে হয়। সংক্ষিপ্ত চিঠি।
শতদল,
একান্ত ইচ্ছা থাকলেও তোমার সঙ্গে দেখা করবার উপায় নেই। কড়া হকুম কিরীটী রায়ের।
নার্সিং হোমে প্রবেশ নিষেধ। তুমি রক্তগোলাপ ভালবাস, তাই কিছু রক্তগোলাপ ও তোমার বান্ধব
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রিয় কড়াপাকের সন্দেশ পাঠালাম। ভালবাসা নিও। ‘রাণু’।
চিঠিটি পড়ে ভাঁজ করতে করতে কিরীটী শতদলের দিকে তাকিয়ে বললে, চিঠিটা আমার কাছে থাক শতদলবাবু।
বেশ।
কিরীটী চিঠিটা জামার পকেটে রেখে দিল, চলুন ডাক্তার। ওঁকে আমাদের বিশ্রাম দেওয়াই প্রয়োজন। উনি বিশ্রাম করুন।
আমরা সকলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
ডাক্তারের কাছে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে, তুই এগো সুব্রত, আমি ডাক্তারকে একটা কথা বলে আসি!