ডাক্তার জবাব দিলেন, হ্যাঁ, এখানকার বিখ্যাত মিষ্টান্নের দোকান। এদের কড়াপাকের সন্দেশ খুবই বিখ্যাত এবং খেতেও খুব ভাল।
বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল, গোটা-বারো সন্দেশ তখনও অবশিষ্ট আছে।
সরলা মিত্র এসে কক্ষে প্রবেশ করল, আমাকে ডেকেছিলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?
কে, সরলা? এস। আমি ঠিক নয়, ইনি। একে তুমি চেন না, বিখ্যাত লোক—কিরীটী রায়।
নমস্কার। সরলা হাত তুলে নমস্কার জানায়।
চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে মিস মিত্রের। বেশ গোলগাল চেহারা এবং চোখে-মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে।
নমস্কার। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই মিস মিত্র। কিরীটী বললে।
বলুন!
৩নং কেবিনে অর্থাৎ শতদলবাবুর কাছে আজ যখন ভিজিটার্স আসেন, আপনি সে সময় নিচে ডিউটিতে ছিলেন শুনলাম!
হ্যাঁ।
সময়টা আপনার মনে আছে কি?
হ্যাঁ, সাড়ে তিনটে হবে।
যিনি এসেছিলেন তিনি দেখতে কেমন?
বাইশ-তেইশ বছরের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা।
মহিলা!
হ্যাঁ। তিনি শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বললাম পারমিশন নেই—তখন একথোকা গোলাপফুল ও একটি মিষ্টির বাক্স দিয়ে আমায় অনুরোধ জানান শতদলবাবুর ঘরে সেগুলো পেছে দিতে।
সঙ্গে তাঁর আর কেউ ছিল?
না।
তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন?
হয়তো চিনতে পারব, তবে চোখে কালো চশমা ছিল।
১৩. একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা
বাইশ-তেইশ বৎসর বয়সের একজন সুশ্রী সুবেশা মহিলা কিছু রক্তলাল গোলাপ ও এক বাক্স মিষ্টি-কড়াপাকের সন্দেশ-সঙ্গে নিয়ে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন! চোখে তাঁর কালো লেন্সের চশমা ছিল অর্থাৎ সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, মহিলা যেই হোন না কেন, তিনি তাঁর মুখখানির স্পষ্ট পরিচয়টা দিতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক ব্যাপার, তাঁর দেওয়া মিষ্টি খেয়েই শতদল অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি ডাঃ চ্যাটার্জী এসে পড়ায় কোনমতে শতদলকে সুস্থ করে তোলা হয়েছে। মরফিন পয়েজনিং কেস। শতদলকে মিষ্টির সঙ্গে মরফিন দিয়ে কৌশলে তাহলে হত্যা করারই চেষ্টা করা হয়েছিল। আবার শতদলের প্রাণহরণের প্রচেষ্টা এবং এবারে ডাঃ চ্যাটার্জী ঠিক সময়ে শতদলের অসুস্থতার সংবাদ না পেলে তাঁকে হয়তো বাঁচানোই যেত না! পরিকল্পনাটিও চমৎকারই বলতে হবে–মিষ্টির সঙ্গে বিষপ্রয়োগ! কিন্তু কে সেই ভদ্রমহিলা?
ভাল কথা মিস মিত্র, ভদ্রমহিলা তাঁর নাম বলেননি? আমিই প্রশ্ন করি।
না। নাম তো কিছু তিনি বলেননি, তবে একটা মুখ-আঁটা নীল খামে চিঠি দিয়েছিলেন ঐ সঙ্গে, শতদলবাবুর নাম উপরে লেখা। চিঠিটা দিয়ে বলেছিলেন, ঐ চিঠিটা দিলেই সব তিনি বুঝতে পারবেন। আমি সেই চিঠি, ফুল ও মিষ্টির বাক্সটা এনে উপরের ইনচার্জ নার্স মিসেস মহান্তির হাতে দিই।
ও, তাহলে মিসেস মহান্তিই তখন উপরে ডিউটিতে ছিলেন! কথাটা বলে কিরীটী মিস মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মিসেস মহান্তি কি এখন এখানে উপস্থিত আছেন? তাঁকে একটিবার অনুগ্রহ করে যদি এই ঘরে ডেকে আনেন মিস মিত্র।
মণিকার এখন off-duty হলেও বোধ হয় নার্সিং হোমেই আছে। দেখছি যদি না বাইরে গিয়ে থাকে তো পাঠিয়ে দিচ্ছি!
মিস মিত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী চেয়ারের ওপরে বসে অন্যমনস্ক ভাবে সম্মুখের টেবিলের উপর থেকে একটা কাঁচের কাগজ চাপা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। চোখের দৃষ্টি স্তিমিত। অন্যমনা।
বুঝতে পারলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা ঐ মুহূর্তে তার মনের অবগহনে আলোড়ন তুলেছে। কোন একটা সূত্রকে ধরবার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। তাই তার দেহে ও মনে একটা শিথিল নিষ্ক্রিয়তা।
শতদলকে কেন্দ্র করে একটা দুর্বোধ্য রহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছিল— সীতার আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যু সেটাকে আরো জট পাকিয়ে তুলেছে।
ঘটনাগুলো যেন পরস্পরের সঙ্গে একান্তভাবেই বিচ্ছিন্ন। শতদলকে হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে সীতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করবার কী এমন কার্য-কারণ থাকতে পারে বুঝতে পারছি না। হত্যার মোটিভ কী? শতদলকে হত্যা করবার তবু, একটা কারণ থাকতে পারে, কিন্তু সীতা নিহত হল কেন? কী উদ্দেশ্য নিহিত আছে তার হত্যার সঙ্গে? তবে কি দুটো ব্যাপারের সঙ্গে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক নেই? শতদলকে হত্যা-প্রচেষ্টা ও সীতাকে হত্যা করা—একের উদ্দেশ্যের সঙ্গে অন্যের উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্কই নেই? ঘটনাচক্রে একটির সঙ্গে অন্যটি জড়িয়ে গিয়েছে মাত্র?
বাইরে পদশব্দ পাওয়া গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজার ভারী নীল রঙের পর্দাটা তুলে কক্ষে প্রবেশ করলেন ৩০/৩২ বৎসরের একটি নার্স।
ডক্টর চ্যাটার্জী, আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?
মিসেস মহান্তি! হ্যাঁ, আসুন। পরিচয় করিয়ে দিই, ইমি মিঃ রায় উনিই আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চান। ডাঃ চ্যাটার্জীই মিসেস মহান্তিকে আহ্বান জানালেন।
মুখের দিকে চেয়ে কেবলমাত্র মুখাবয়ব থেকে মিসেস মহান্তির বয়স নিরুপণ করা কষ্ট। বেশ গোলগাল স্থূল চেহারা-চোখেমুখে একটা সরল নিরীহ বোকা বোকা ভাব।
মিসেস মহাতি ডাঃ চ্যাটার্জীর কথায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই বারেকের জন্য দৃষ্টি নামিয়ে নিলেন।
মিসেস মহান্তি, আপনি তো আজ উপরে ডিউটিতে ছিলেন?
মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন মিসেস মহান্তি।