কী ঘটেছিল বলুন তো?
এমন বিশেষ কিছুই নয়। এই তো পরশু রাত্রে যে ঘরে শুই—আমার ঠিক শিয়রের ধারে মাথার উপরে দেওয়ালের গায়ে মস্ত বড় একটা অয়েলপেন্টিং টাঙানো ছিল, হঠাৎ মাঝরাত্রে সেটা ছিড়ে আমার মাথার কাছেই পড়ে—অবশ্য অল্পের জন্যই আঘাত পাইনি
হুঁ। আর কোন ঘটনা ঘটেছে?
গতকাল সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের গায়ের ঢালু পথ বেয়ে নিচে নেমে আসছি, হঠাৎ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়াতে গড়াতে আর একটু হলে হয়তো আমার ঘাড়েই পড়ত এবং ঐ পাথরটা এসে গায়ে পড়লে একেবারে যে পিষে ফেলত তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে দুটো ব্যাপারই তো pure and simple accident! আমার জীবনের ওপরে attempt বলি কী করে! আপনি না বললে হয়তো মনেও পড়ত না, ভুলেই গিয়েছিলাম।
ভুলে যে যাননি তার প্রমাণ আপনার ঘটনা দুটির narration এবং আগের দুটি যেমন আপনার জীবনের উপরে attempt হয়েছিল, আজও ঠিক তেমনি চেষ্টা হয়েছিল। তিন-তিনবার নিষ্ফল হয়েছে যখন, চতুর্থবারের প্রচেষ্টা হয়তো খুব শীঘ্রই হবে। সাবধান হবেন।
কিরীটীর চরিত্রের সঙ্গে আমি যতখানি পরিচিত অনেকেই তা নয় এবং বিশেষ করে সে যখন কোন সাবধান বাণী উচ্চারণ করে, তার গুরুত্ব যে কতখানি সেও আমার চাইতে বেশী কেউ জানে না। কিন্তু শতদলবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, তিনি যেন কিরীটীর কথায় কোন গুরুত্বই আরোপ করতে পারছেন না। সামান্য দু-চারটে কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝেছিলাম, শতদলবাবু মানুষটি বেশ দিলখোলা ও সরল প্রকৃতির। সংসারের কূটনীতি যেন তাঁকে কোনরুপে স্পর্শই করতে পারে না।
শতদল হাসতে হাসতেই এবার প্রত্যুত্তর দিলেন, আপনি যখন অত করে বলছেন মিঃ রায়, চেষ্টা করব সাবধান হতে।
হ্যাঁ, করবেন। এবং শুধু বাইরেই নয়, বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকবেন।
বাড়ির মধ্যেও সাবধানে থাকব? কী বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না!
এই ধরুন, যে ঘরে আপনি রাত্রে শয়ন করেন সে ঘরটা ভাল করে দেখেশুনে শোবেন।
কেন বলুন তো, রাত্রেও কেউ আমার শয়নঘরে চড়াও হয়ে আমার প্রাণহানি করবার চেষ্টা করবে নাকি?
ঘরের বাইরে ও ভিতরে যখন চেষ্টা হয়েছে, সেটা কিছু অসম্ভব নয়।
সহসা এমন সময় কুড়ি-বাইশ বৎসরের অপরূপ সুন্দরী একটি তরুণী হোটেলের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা একেবারে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শতদলবাবুকই সম্বোধন করে বললে, বাবাঃ, এতক্ষণে তোমার আসবার সময় হল? দোতলার বারান্দা থেকে তোমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসছি। স্টেশনে আসনি কেন?
তরুণীর কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে আমরা তিনজনেই আগন্তুক তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম।
এই তো, সবে সকালেই আজ তোমার চিঠি পেয়েছি রাণু—তুমি কবে এসে পৌচেছ?
কাল সকালের গাড়িতে, রাণু জবাব দেয়, কিন্তু সত্যি তুমি আজই আমার চিঠি পেয়েছ?
হ্যাঁ। কৌতুকোজ্জল দৃষ্টিতে তাকায় শতদল রাণুর মুখের দিকে। বিশ্বাস করি না। অভিমান-ক্ষরিত কণ্ঠে রাণু, জবাব দেয়।
সে হবেখন। এসো আগে এদের সঙ্গে তোমার আলাপটা করিয়ে দিই রাণু। আশ্চর্য ভাবেই এদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল এইমাত্র। একে চেনো? বিখ্যাত রহস্যভেদী কিরীটী রায় আর ইনি সুব্রত রায়।
শতদলের কথায় রাণু, আমাদের দিকে তাকাল। কিন্তু আমাদের পরিচয় পেয়ে যে সে বিশেষ কিছু আনন্দিত হয়েছে তেমন কোন কিছু তার মুখের চেহারায় বোঝা গেল না।
তথাপি সে হাত তুলে বোধ হয় একান্ত সৌজন্যের খাতিরেই আমাদের নমস্কার জানাল।
সহসা এমন সময়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, চল, সুব্রত, সমুদ্রের ধারে একটু বেড়িয়ে আসা যাক।
বলে কাউকে কোনরুপ আর কোন কথার অবকাশ মাত্রও না দিয়ে সমুদ্রসৈকতের দিকে এগিয়ে চলল। অগত্যা কতকটা যেন বাধ্য হয়েই তাকে আমি অনুসরণ করলাম।
কিরীটীর হঠাৎ এভাবে চলে আসাটা কেমন যেন আকস্মিক ও বিসদৃশ বলেই আমার কাছে মনে হল।
কিন্তু কিরীটী বেশী দূর অগ্রসর না হয়েই সামনেই জলের একেবারে কোল ঘেষে বালুর উপরেই একটা জায়গায় হঠাৎ বসে পড়ল। আমিও পাশে বসলাম।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। কারো মুখে কোন কথা নেই। বুঝলাম, কোন একটা বিশেষ চিন্তা আপাততঃ কিরীটীর মাথার মধ্যে ফেনিয়ে চলেছে।
জিজ্ঞাসা করলাম, কি ভাবছিস কিরীটী?
কিরীটী আনমনে সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে ছিল। সেই দিকেই তাকিয়ে সে বলল, পর পর দুটি আবির্ভাব। বুলেট ও নারী সুন্দরী তরুণী!
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে এমন একটা কিছু ছিল যাতে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে আমি পারলাম না।
০২. আবার সমুদ্রের দিকে
কিরীটী কিছুক্ষণ আবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
হঠাৎ আবার কতকটা যেন খাপছাড়া ভাবেই কিরীটী বলে উঠল, এমন সুন্দর পৃথিবী অথচ মানুষগুলোর কি বিচিত্র স্বভাব! শান্তির মধ্যে নিশ্চয় তার মধ্যে যেন ওরা কিছুতেই দিন কাটাতে চায় না!
মৃদু হেসে বললাম, কেন, তোর আবার শান্তির অভাব ঘটল কিসে?
এখনো বলছিস অভাব হল কিসে? এর পরও শান্তিতে থাকতে পারব বলে মনে করিস? দুর্ঘটনাটা ঘটবার সঙ্গে সঙ্গে স্থির করেছিলাম ওদিকে চোখ দেব না কিন্তু শতদল আর রাণু, নাঃ, কিছুতেই যোগে মিলছে না। কিন্তু তারও আগে সর্বাগ্রে আমাকে একটিবার ঐ নির্জন সাগরকূলে পাহাড়ের উপরে নিরালা নামক বাড়িখানি দেখতে হচ্ছে—