আরও বললেন, এ গৃহ তাঁর পরিচিত, আগেও নাকি দু-একবার এসেছেন এখানে শিল্পী রণধীর চৌধুরীকে দেখতে। এবং সীতাকেও তিনি চিনতেন। এই বাড়িতেই আলাপ হয়েছিল রণধীর চৌধুরীর জীবিতকালে।
কিরীটীর অনুরোধে শতদলকে ডাঃ চ্যাটার্জী পরীক্ষা করলেন। বললেন, Simple nervous shock! একটু স্টিমিউলেন্ট ও কটা দিন বিশ্রাম পেলেই আবার চাঙ্গা হয়ে উঠবেন।
এমন সময় কিরীটী ডাঃ চ্যাটার্জীকে অনুরোধ জানাল, আমারও তাই মত ডাঃ চ্যাটার্জী। এবং আমার ইচ্ছে, শতদলবাবুর উপর দিয়ে উপর্যপুরি কয়েক দিন ধরে যে নার্ভাস স্ট্রেন গিয়েছে তাতেই তিনি আজকের দুর্ঘটনায় একেবারে ব্রেকডাউন করেছেন, এ অবস্থায় আমার মনে হয় যদিও আমি ডাক্তার নই—ওঁর কিছুদিন রেস্ট নেওয়া অবশ্যই কর্তব্য—complete bodily and mental rest এবং এখানে নয়—অন্য কোন জায়গায় স্থান-পরিবর্তন করা এখন বিশেষ প্রয়োজন। আপনি কী বলেন ডাঃ চ্যাটার্জী?
খুব ভাল হয় তাহলে! You are right!
আপনার নার্সিং হোমে সুবিধা হয় না?
আমার নার্সিং হোমে?
হ্যাঁ। আমার তো মনে হয়, ওঁর পক্ষে আপনার নার্সিং হোমই সব চাইতে ভাল জায়গা হবে। আপনার কেয়ারেও থাকবেন উনি এবং strict order থাকবে। কেউ যেন ওঁর সঙ্গে দেখা না করতে পারে।
বেশ তো। তা হতে পারে।
কোন সিঙ্গল রুম খালি আছে কি?
তা আছে।
তবে সেই ব্যবস্থাই ভাল। এখনি ওঁকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা তাহলে করুন।
বেশ তো, আমার টমটম এনেছি—আমার সঙ্গে উনি চলুন।
সেই মত ব্যবস্থাই হল। আমার ওপরেই কিরীটী ভার দিল ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে শতদলবাবুকে নিয়ে গিয়ে একেবারে নার্সিং হোমে পৌঁছে দিয়ে আসার।
কিরীটী ও মিঃ ঘোষাল থেকে গেলেন মৃতদেহের একটা ব্যবস্থা করবার জন্য।
গতকাল থেকে শতদলবাবু ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোমেই আছেন। নার্সিং হোমে স্ট্রিক্ট অর্ডার দেওয়া আছে একমাত্র কিরীটী ও রসময়বাবু ছাড়া এবং তাঁদের বিনানুমুতিতে কোন ভিজিটার্সকেই কোন উপলক্ষে শতদলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে না।
সীতার আকস্মিক মৃত্যুর পর হতেই কিরীটীকে লক্ষ্য করেছিলাম হঠাৎ যেন সে বেজায় গম্ভীর হয়ে উঠেছে। কি একটা চিন্তা যেন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরো একদিন পরের ঘটনা। হঠাৎ নার্সিং হোম থেকে একজন লোক সংবাদ নিয়ে এল, সন্ধ্যার কিছু পরে ঘণ্টাখানেক আগে থেকে শতদলবাবু নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং ডাঃ চ্যাটার্জী অবিলম্বে কিরীটীকে একবার নার্সিং হোমে যেতে বলেছেন। ডাক্তার তাঁর টমটম পাঠিয়ে দিয়েছেন।
আমি ও কিরীটী আর কালবিলম্ব না করে তখনি নার্সিং হোমে যাবার জন্য টমটমে উঠে বসলাম।
ছোট্ট শহর। হোটেল থেকে প্রায় মাইলখানেক দুরে স্টেশনের কাছে ডাঃ চ্যাটার্জীর নার্সিং হোম। প্রায় একবিঘে জমির ওপরে বাগান, এক-মানুষ সমান উঁচু প্রাচীরঘেরা সীমানার মধ্যে দোতলা একটি বাড়িনার্সিং হোম। বাইরে থেকে একমাত্র গেট ছাড়া নার্সিং হোমের মধ্যে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য বললেও অত্যুক্তি হয় না।
সোজা আমরা টমটম থেকে নেমে দোতলার কোণের ঘরে যেখানে শতদলবাবু আছেন সেই ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলাম।
শয্যার ওপরে শতদলবাবু শুয়ে। বুক পর্যন্ত চাদরে আবৃত। চোখ দুটি বোজা।
পাশে দাঁড়িয়ে ডাঃ চ্যাটার্জী শতদলকে একটা ইনজেকশন দিচ্ছেন। পাশেই দাঁড়িয়ে একজন নার্স।
ইনজেকশন দেওয়া শেষ হলে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন ডাক্তার নাসের হাতে সিরিঞ্জটা দিয়ে, চলুন আমার ঘরে। ভয় বোধ হয় কেটে গিয়েছে।
ডাঃ চ্যাটার্জীর ঘরে এসে আমরা বসলাম।
কি ব্যাপার ডাঃ চ্যাটার্জী?
Morphia poisoning-কেউ বোধ হয় শতদলবাবুকে মরফিয়া খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিল।
বলেন কি? কিরীটীই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। হঠাৎ নার্স এসে ঠিক সময়মত আমায় খবরটা না দিলে বোধ হয় রক্ষা করা যেত না life। অতঃপর একটু থেমে বললেন, এখন তো দেখছি সেদিন ওঁকে এখানে এনে ভালই করেছি।
কিন্তু কি করে সম্ভব হল? How it was done? প্রশ্ন করলাম আমি।
প্রথমটায় বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি দুপুরের দিকে কে একজন ভিজিটার্স দেখা করতে এসেছিল, কিন্তু দেখা করার অর্ডার না থাকায় নার্স দেখা করতে দেয়নি। ভদ্রলোক কিছু ফুল ও একটা কাগজের বাক্সে কিছু মিঠাই রেখে যান ওঁকে দেবার জন্য। সেই মিঠাই খেয়েই নাকি–
হুঁ। আচ্ছা ডাক্তার, আপনার সেই নার্স—যার হাতে সেই ভদ্রলোক ফল ও মিঠাই দিয়ে গিয়েছিল, এখানে তাকে একবার ডাকতে পারেন? তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
নিশ্চয়ই।
ডাক্তার বেল বাজালেন। বেয়ারা এসে ঘরে ঢুকল, ডঃ চ্যাটার্জী তাকে বললেন, নার্স সরলা মিত্রকে ডেকে দিতে। নিচের ওয়ার্ডে সরলা মিত্র তখন ডিউটিতে ছিল।
ভাল কথা ডাঃ চ্যাটার্জী, যে মিষ্টি খেয়ে শতদলবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েন তার কিছু অংশ এখনো বাকি আছে নিশ্চয়ই! কিরীটী ডাক্তারকে শুধায়।
হ্যাঁ, বোধ হয় গোটা দুই সন্দেশ খেয়েছিলেন বাকিটা এখনো বাক্সেই আছে, রেখে দিয়েছি বাক্সটা সমেত, বলতে বলতে বসবার টেবিলের ডানদিককার ড্রয়ার চাবি দিয়ে খুলে ড্রয়ারটা টেনে কাগজের একটি ফ্যান্সি চৌকো বাক্স বের করে দিলেন ডাঃ চাটাজী।
ফ্যান্সি কাগজের চৌকো বাক্স। বাক্সের উপরে চমৎকার একটা ডিজাইন ও দোকানের নাম লেখা—বান্ধব সুইট হোম। কাগজের বাক্সের উপর লেখা নামটা পড়তে পড়তে কিরীটী বললে, এ তো দেখছি এখানকারই দোকান!