আজ্ঞে দুটোর একটাও নয়। মাসখানেক হল বিশেষ একটা কাজে এখানে এসে আছি। ঐ দেখছেন যে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের ওপর বাড়িটা—ঐ বাড়িতেই আমি থাকি।
শতদলবাবুর কথা অনুসরণ করে দক্ষিণদিকে আমরা তাকালাম। সমুদ্রের কোল ঘেষে একটা ছোট পাহাড়, তারই উপরে যেন ঐতিহাসিক দুর্গের মতো বাড়িটা দূর থেকে মনে হয়। দুর্গের মতো পাহাড়ের উপরের ঐ বাড়িটার প্রতি এখানে এসে পৌঁছবার পরদিনই প্রত্যুষে কিরীটী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দূর হতে মনে হয় একখানা ছবি। পাহাড়টা লোকালয় হতে আধ মাইলটাক দূর তো হবেই।
কিরীটী শতদলবাবুর কথায় দূর পাহাড়ের মাথায় দুর্গের মতো বাড়িটার দিকে তখনও তাকিয়ে ছিল অন্যমনে। একসময় ঐ দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, অদ্ভুত জায়গায় বাড়িটা তৈরী করা হয়েছে। বাড়িটা যিনি তৈরী করেছিলেন তাঁর সম্পর্কে দুটো কথা কেউ না বললেও, স্বতঃই মনে হয়—
কী বলুন তো? সকৌতুকে শতদল প্রশ্ন করে।
প্রথমতঃ, যিনিই বাড়িটা তৈরী করে থাকুন, বিশেষ খেয়ালী-প্রকৃতির ছিলেন তিনি। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর অর্থের অভাব ছিল না—
আশ্চর্য! সত্যি তাই। বাড়িটা আমার দাদামশাইয়ের। এককালে পূর্ববঙ্গে ওঁদের সবিস্তীর্ণ জমিদারী ছিল। যার আয় ছিল শুনেছি প্রায় বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকা। আর দাদামশাই লোকটিও ছিলেন নিজে একজন নামকরা চিত্র ও মৃৎশিল্পী। শিল্পী রণধীর চৌধুরীর নাম শুনেছেন নিশ্চয়!
নিশ্চয়ই। শুনেছি বৈকি। অত বড় শিল্পপ্রতিভা নিয়ে আমাদের দেশে খুব কম লোকই জন্মেছেন। আপনি তাঁরই দৌহিত্র?
হ্যাঁ। তাঁর একমাত্র মেয়ের একমাত্র পুত্র। তাঁর বিরাট সম্পত্তির শেষ ও একমাত্র অবশিষ্ট তাঁর ঐ নিরালা নামক পাহাড়ের ওপরে বাড়িখানার ওয়ারিশন। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে শতদল বললে।
একজন শিল্পীর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মূল্যের দিকে যাচাই করতে গেলে হয়তো আপনাকে হতাশই হতে হবে। কিন্তু সাগরের উপকূলে ঐ পাহাড়ের উপর নগরের কোলাহল হতে দূরে অমন একখানা বাড়ির মধ্যে যে মহামূল্যবান সৌন্দর্য-সৃষ্টির ইঙ্গিত ওর প্রতিটি গাঁথুনির মধ্যে ওতোপ্রোত হয়ে জড়িত আছে, তার মূল্য নিছক স্রেফ কাঞ্চনমুল্যে তো ধার্য করা যায় না শতদলবাবু। বিশেষ মূল্যেই যে ওর বিশেষত্ব।
শতদলবাবু কিরীটীকে বাধা দিয়ে কী বলতে উদ্যত হতে কিরীটী বলে ওঠে, না না শতদলবাবু এ সংসারে সব কিছুকেই নিছক টাকার নিক্তিতে ওজন করবেন না। এ শিল্পীর প্রতিভা আপনিও হয়তো আমার দাদার মতই শিল্প-পাগল, তাই ওই নির্জন সমুদ্রের উপকূলে জনমানবের বসতি ছাড়িয়ে পাহাড়ের উপর বাড়িখানা দূর থেকে দেখেই অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্যের আভাস পাচ্ছেন। এবং বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করলে হয়তো আরও কিছু দেখতে পাবেন। কারণ বাড়ি-ভর্তি সব নর-নারীর স্ট্যাচু এবং অয়েল ও ওয়াটারকলার পেন্টিং, এ ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু আমি অত্যন্ত বস্তুতান্ত্রিক লোক, অতি সাধারণ ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ, আমার কাছে ওর কী-ই বা মূল্য বলুন! শতদল হাসতে হাসতে বলে।
মানুষের মন এমনিই বিচিত্র বটে মিঃ বোসু কিন্তু মন আপনার যতই বস্তুতান্ত্রিক হোক, আপাততঃ ক্ষমা করবেন, একটা কথা আপনাকে আমি কিন্তু না বলে পারছি না—আপনার প্রাণটি নেবার জন্য কেউ-না-কেউ অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।
এবারই হাসালেন মশাই। আমার মত একজন অতি সাধারণ লোকের প্রাণের এমন কি মূল্য আছে বলুন তো যে সেটি নেবার জন্য কেউ উদগ্রীব হয়ে উঠবে! না আছে আমার অগাধ সম্পত্তি, না আছে এ দুনিয়ায় আমার কোন শত্রু।
হতে পারে, তবে আমার কথায় যদি বিশ্বাস করেন তাহলে জানবেন it was a pure and simple attempt on your life!
সত্যি নাকি? আমার কৌতূহলটা মাপ করবেন, আপনার নামটি জানতে পারি কি?
কিরীটী রায়। মৃদুকণ্ঠে কিরীটী জবাব দেয়।
নমস্কার। আপনিই কি বিখ্যাত সেই রহস্যভেদী কিরীটী রায়?
বিখ্যাত কিনা জানি না, তবে আমিই কিরীটী রায়। মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়।
আর উনি?
সুব্রত।
কী সৌভাগ্য, আপনার মত লোকের এখানে পদার্পণ হয়েছে অথচ জানতেও পারিনি! তা আসুন না আজ আমার বাড়িতে। রাত্রির আহারূপর্বটা গরীবের ঘরেই সারবেন।
বিলক্ষণ, সে একদিন হবেখন। তবে আজ নয়, কাল সকালের দিকে যাব, আপনার ঐ বাড়িটা দেখতে। কিরীটী জবাব দেয়।
আসবেন, নিশ্চয় আসবেন কিন্তু। শতদলবাবু অনুরোধ জানান দরদ দিয়ে।
যাব। কিন্তু আমার কথাটা মনে থাক যেন।
কি বলুন তো? শতদল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল আবার।
একটু সাবধানে থাকবেন। আপনার আততায়ীটীর নিশানা একবার ব্যর্থ হলেও, বার বার ব্যর্থ নাও হতে পারে।
সত্যিই কি আপনার তাই সন্দেহ নাকি কিরীটীবাবু, আমার জীবনের উপরেই কেউ attempt নিয়েছিল!
কোন ভুল নেই তাতে। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, একটু ভেবে বলুন তো—আজকের এই দুর্ঘটনার আগে আপনার অন্য কোন accident দুদশদিনের মধ্যে হয়েছে কিনা?
Accident!
হ্যাঁ, মানে কোনপ্রকার দুর্ঘটনা?
কই, এমন বিশেষ কোন ঘটনা তো আমার মনে পড়ছে না যাকে প্রাণহানিকর দুর্ঘটনার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে।
ভেবে দেখুন
না মশাই। তবে, কিন্তু তাকে দুর্ঘটনাই বা বলি কি করে এবং সেগুলো যে আমার জীবনের ওপরেই attempt নেওয়া হয়েছে তাই বা