হাতের মধ্যে ধরা বাংলা বইটা বাজিয়ে কিরীটীর কথায় সামনের দিকে তাকালাম, শ্লথ মন্থর পায়ে যুবকটি এইদিকেই আসছে। একেবারে পথের ধারের ঝাউবীথি ঘেষে আসছে যুবক। মুখের রঙ শ্যামবর্ণই। মাথার একরাশ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, বাতাসে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। চুলের সঙ্গে তেলের বা চিরুনির যে সংস্পর্শ বড় একটা নেই বোঝা যায় বিস্রস্ত রুক্ষ চুলগুলো দেখে। যুবকের দুটি হাতই পরিহিত গ্রেট কোটের দু পাশের পকেটে প্রবিষ্ট। মুখটা নিচু করে হাঁটার দরুন ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। মনে হয় কোন কারণে যুবক যেন একটু চিন্তিতই।
ভদ্রলোকটি বোধ হয় কিছু ভাবছেন!
ভাবছেন? কী ভাবছেন? কিরীটী প্রশ্ন করে, হিত না অহিত?
চলতে চলতে ঐ সময় যুবকটি একবার সামনের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকাল।
তা কী করে বলি, থটরীডিং তো জানা নেই!
থট রীড করতে তো বলিনি তোকে, বলেছি ভদ্রলোকের গেইট, অর্থাৎ চলাটা দেখে বলতে,—অর্থাৎ পা থেকে মাথা।
কিরীটীর মুখের কথাটা শেষ হল না, হঠাৎ কেমন একটা অস্পষ্ট শব্দ কানে এল। সেই সঙ্গে-সঙ্গেই প্রায় উপবিষ্ট কিরীটীর পাশেই লাঠির মাথায় বসানো তার শোলার টুপিটা ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ল ও অস্ফুট একটা কাতর শব্দও কানে এল।
ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। জায়গাটায় হাওয়া ছিল কিন্তু হাওয়ার বেগ এত ছিল না, যাতে করে সহসা অমন করে লাঠির মাথায় বসানো কিরীটীর টুপিটা উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়তে পারে।
সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, মাত্র হাত ৮।১০ ব্যবধানে একটু পূর্বে যে যুবকটিকে কেন্দ্র করে আমাদের কথাবার্তা চলছিল, সে বাঁ হাতে তার নিজের ডান কাঁধটা চেপে মাটির উপরেই বসে পড়েছে। আমি তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেলাম যুবকটির দিকে। তার সামনে গিয়ে পৌঁছবার আগেই যুবক উঠে দাঁড়িয়েছে, চোখে-মুখে তার সুস্পষ্ট একটা যন্ত্রণার চিহ্ন। যুবকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, পড়ে গিয়ে হঠাৎ কাঁধে লাগল বুঝি? পড়ে গেলেন কি করে?
আমার প্রশ্নে যুবকটি মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। মৃদুকণ্ঠে বললে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ কাঁধে যেন একটা ধাক্কা লাগতে পড়ে গেলাম আচমকা। না, তেমন কিছু লাগেনি।
হঠাৎ ধাক্কা লাগল মানে? বিস্মিত আমি প্রশ্ন করলাম।
কিরীটী ইতিমধ্যে তার টুপিটা মাটি হতে কুড়িয়ে আমাদের কাছে এসে কখন দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। সহসা অতি নিকটে তার কণ্ঠস্বর শুনে যুগপৎ আমরা দুজনেই ফিরে তাকালাম।
মনে হচ্ছে একটা বুলেট সুব্রত!
বুলেট! সবিস্ময়ে কথাটা উচ্চারণ করে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে ঘুরে তাকালাম।
কিরীটী কিন্তু তখনও গভীর মনোযোগ সহকারে তার হস্তধৃত টুপিটা ঘুরিয়ে দেখছে এবং দেখতে দেখতেই মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ নিশ্চয়ই it was a bullet and that blessed bullet pierced through and through my poor hat!
এবং কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় হস্তধৃত টুপিটা আমার চোখের সামনে তুলে ধরে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি আমার কথাটা? Well see—এই দেখ!
তাকিয়ে দেখলাম কিরীটীর কথা মিথ্যা নয়, সত্যি। টুপিটার দুই দিকে দুটি গোলাকার ছিদ্র।
কিন্তু সর্বাগ্রে আপনাকে একবার দেখা দরকার। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান যুবকটির দিকে অগ্রসর হয়। বুঝতে অবশ্য পারছি আঘাতটা নিশ্চয়ই তেমন মারাত্মক হয়নি, তা হলেও আপনার কাঁধের ক্ষতস্থানটা একটিবার পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। জামাটা খুলেন তো!
না না—বিশেষ কিছু হয়নি, যুবকটি কাঁধের উপর থেকে ততক্ষণে হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন। স্মিতভাবে বললেন, ব্যস্ত হবেন না।
আপনি বলছেন কি—মানে—
আমার নাম শতদল বোস। না, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। মৃদু হাস্যতরল কণ্ঠে জবাবটা দিলেন মিঃ বোস। এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় গায়ের গরম ওভারকোটটা খুলে ফেলে দিলেন। কোটের নিচে সাদা টুইলের শার্ট ছিল। দেখা গেল মিঃ বোসের কথাই সত্য। গুলিটা তাঁর কাঁধ ছুঁয়ে গেলেও কোটের নীচে শার্ট পর্যন্তও পৌঁছয়নি। বোধ হয় সামান্য কাঁধের উপর দিয়ে ছুঁয়ে গেছে, যার ধাক্কাতেই বেমক্কা তিনি টলে পড়ে গেছেন।
যাক গে—না লেগে থাকলেই ভাল! But it was a bullet-এযাত্রা খুব বেঁচে গেছেন যা হোক। কিরীটী স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলে।
মিঃ বোস আবার কথা বলেন, কিন্তু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না তো! আপনি বলছেন একটা বুলেট, কিন্তু কই, কোন ফায়ারিং-এর শব্দও শুনলাম না! তা ছাড়া এখানে আমাকে গুলিই বা করবে কে? এবং কেন
কে আর করবে! করেছেন অবশ্য তিনিই যিনি হয়তো এ পৃথিবীতে আপনার বেঁচে থাকাটা বাঞ্ছনীয় মনে করছেন না। তা ছাড়া ফায়ারিং-এর শব্দ বলছেন? সমুদ্রের হাওয়া ও সী-বীচের স্নানার্থীদের একটানা হৈ-হল্লার মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দটা না শুনতে পাওয়াটাও বিশেষ কিছু আশ্চর্য নয়। তা ছাড়া পিস্তলে সাইলেন্সারও তো লাগানো থাকতে পারে। তাতেও আপনি ফায়ারিংএর শব্দ শুনতে পাবেন না। কিন্তু কেউ না কেউ যে একটা গুলি ছুড়েছে সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। বলতে বলতে হঠাৎ কথাটার মোড় ঘুরিয়ে কিরীটী অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, আপনিও আমাদের মতো স্বাস্থ্যান্বেষী নাকি মিঃ বোস? না এইখানেই থাকেন?